- হোম
- >
- ইতিহাস-ঐতিহ্য
- >
- পণ্য !
বাংলার কথা কই
পণ্য !
হাসান মাহমুদ
প্রিন্টঅঅ-অ+
(এ জাহাজ সে জাহাজ নয় …………….)
হাট বসেছে, হাট!
লোকে লোকারণ্য। সদ্য-ধরা সাদা চকচকে মাছ সাজিয়ে বসেছে জেলে, ক্ষেত থেকে লাউ শশা কাঁচামরিচ ডালায় সাজিয়ে বসেছে গেরস্ত। ও পাশটায় দড়িবাঁশের বিরাট দাঁড়িপাল্লার পাশে বস্তাবন্দি ধান চাল নিয়ে বসেছে বড় ব্যবসায়ী। বস্তাভর্তি গরু মোষের গাড়ি নামিয়ে রাখা আছে, জাবর কাটছে গাছে বাঁধা গরু মোষ। ছোট্ট দোকানে আলতা, মেহেদি আর সিঁদুর নিয়ে বসেছে মনোহারী।- গামছা, লুঙ্গি, ধুতি, কেরোসিন তেল আর লবণ নিয়ে বসেছে ছোট ব্যবসায়ী। থলি হাতে আসছে লোক, বাচ্চার হাত ধরে আসছে কেউ। ভেঁপুবাঁশি আর ল্যাবেনচুষও আছে হাটে। আছে মাটির বাসন, খেলনা। হাজার পায়ের আঘাতে বাতাসে উড়ছে গ্রাম-বাংলার ধূসর ধুলো, সোঁদা একটা চিরপরিচিত গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। হাট বসেছে বাংলার গ্রামে, আজ থেকে মাত্র সাড়ে তিনশ’-চারশ বছর আগে।
জলদস্যুর কোর্তাপোশাক, কোমরে ঝোলানো বিরাট তলোয়ার আর পিস্তল নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছে দক্ষিণ বাংলার মুকুটহীন সম্রাট সিবাস্তিন গঞ্জালেস্, ভীত সন্ত্রস্ত চোখে সরে যাচ্ছে লোক। বাংলা থেকে কোথায় কতদূরে সেই পর্তুগাল! সেখানে না জানি কোন্ বাবা-মা’র কোলে জন্মেছিল ছোট্ট শিশু। না জানি কিভাবে কেটেছে তার শৈশব, কি খেলা খেলত সে বন্ধুদের সাথে। উঠতি বয়সের রোমাঞ্চকর আবিষ্কারগুলো কিভাবে এসেছিল তার জীবনে। সেই সুদূর পর্তুগালে ছেলেটা যখন বড় হচ্ছিল, বাংলার মানুষ ভাবতেও পারেনি পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে একটা মেঘ ঘনীভূত হয়ে উঠছে বাংলার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলবার জন্য, বাঙালির অশ্রু আর্তনাদ আর রক্তস্রোতের ইতিহাসে অগ্নিস্বাক্ষর রেখে যাবার জন্য। সেই মেঘ যখন বাংলায় এল, ঝড় হয়েই এল। প্রচণ্ড জলদস্যু সর্দার হিসেবে বাংলায় পা রাখল গঞ্জালেস্, এবং আর ফিরে গেল না। সাথে রইল তার শক্তিশালী নৌবহর আর দুর্ধর্ষ ছোট একটা দল।
দৃঢ় গর্বিত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে গঞ্জালেস্ হাটের বিশেষ দিকটায়। সাধারণ হাটুরে মানুষ ওদিকে পা মাড়ায় না কখনো। কাছে দূরে বাংলার অনেক ঘরে তখন কান্নার আওয়াজ গুমরে উঠছে। ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে কান্না শোনে মানুষ। বুঝে যায় এবারে এ বাড়িতে মরণছোবল দিয়েছে সিবাস্তিন গঞ্জালেস্ নামের ভয়ানক দানবটা। বছরের পর বছর চলছে এ আর্তনাদ। কে শুনবে? কে রক্ষা করবে, কে বাঁচাবে গ্রাম বাংলার মানুষকে এ দানবের হাত থেকে ? দিল্লী থেকে নিয়োগ করা বাংলার অবাঙালি সুবাদারের তো সময়ই নেই এ নিয়ে মাথা ঘামানোর। সময়ও নেই, শক্তিও নেই।
গঞ্জালেস্ এসে দাঁড়ালো, সারি সারি রাখা আছে বিক্রীর পণ্য। যুদ্ধপোশাকে ঘোড়ায় চড়ে পাহারা দিচ্ছে প্রভুভক্ত অনুচরের দল। তৃপ্তির হাসি গঞ্জালেসের ঠোঁটে। এ পণ্য উৎপাদন করতে তার একটি পয়সাও খরচ হয়নি, সময়ও লাগেনি দু’দিনের বেশি। এখান ওখান থেকে নিয়ে এলেই হল। সারি সারি রাখা আছে বিক্রীর পণ্য। যে পণ্য নড়ে চড়ে কথা বলে। ক্ষুধার্ত হয়, সুখী হয়, দুঃখী হয়। সুযোগ-সুবিধে পেলে স্বপ্নও দেখে।
ও পাশটায় গনগনে কয়লার হাপর চালাচ্ছে কামার। লোহার শিক রাখা আছে জ্বলন্ত কয়লার ওপর, গনগনে লাল হয়ে আছে শিকগুলোর মাথা। ব্যবসা করতে গেলে সবরকম সুবিধেই ক্রেতাকে দিতে হয়, ভাবল গঞ্জালেস্। সে জন্যই তো তার ব্যবসা এত জমাট। অবশ্য এর জন্য প্রচুর আয়োজনও করতে হয়েছে তাকে। সশস্ত্র লোকজন রাখতে হয়েছে, যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে অস্ত্রশস্ত্র কিনতে হয়েছে। তৈরি করতে হয়েছে শক্তিশালী নৌবহর যার সামনে দাঁড়াবার সাহস পায় না দিল্লীর মোহরপ্রাপ্ত বাংলার অবাঙালি সুবাদার। এ পণ্য রপ্তানি হবে ভারতের উপকুলের কিছু শহরে আর কিছু ইউরোপে।
বাংলার হাটে বাংলার মাটিতে সারি সারি বসে আছে হাত-পা বাঁধা বাংলারই হতভাগ্য মানুষগুলো। আতঙ্কে দুমড়ে গেছে চেহারা। অশ্রুর দাগ শুকিয়ে আছে গালে। আতঙ্কে ত্রাসে প্রায় জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে আছে হাত-পা বাঁধা কমবয়সী ছেলেমেয়েগুলো। ঘোড়ায় চড়ে পাহারা দিচ্ছে গঞ্জালেসের বাঙালি অনুচর। গনগনে কয়লায় হাপর চালাচ্ছে বাঙালি কামার। বিদেশি ব্যবসায়ী একটু আগে বেছে বেছে কিনেছে স্বাস্থ্যবান কিছু পণ্য। নিয়তির কি ঘোর অভিশাপে নিজেরই দেশে বসে বিদেশির হাতে ক্রীতদাস হয়ে গেছে বাঙালি। ওদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঐ ওদিকে যেখানে গনগনে কয়লায় রক্তচোখে তাকিয়ে আছে লাল লোহার শিক। এবারে এসে দাঁড়ালেন মা হুয়েন। বিশ্ববিখ্যাত চীনা পর্যটক এবং ঐতিহাসিক। কৌতূহলী চোখে পরিমাপ করলেন পরিবেশটা। নোটবইতে কিছু লিখলেন। মনে পড়ল, ১৩৪৬ সালে মরক্কোর বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা (শেখ মুহম্মদ আব্দুল্লা) কিনেছিলেন বাঙালি কন্যা আশুরাকে এক দিনারে। তাঁর সঙ্গী দুই দিনারে কিনেছিলেন লুলু নামের ছেলেটাকে। মা বাবার কোল থেকে কেড়ে নেয়া সেই ছেলে সেই মেয়ে আজ কোথায় !
আকাশ ফাটানো চিৎকার ভেসে এল কামারশালা থেকে। গনগনে লাল শিক দিয়ে ফুটো করে দেয়া হয়েছে হাতের তালু। যার ভেতরে লোহার শিকল পরিয়ে সারি সারি বাঙালিকে বসিয়ে দেয়া হবে জাহাজের খোলের ভেতরে। কাতর আর্তনাদ ছাপিয়ে উঠবে বাঙালির রক্তাক্ত হাতে বাওয়া সারি সারি দাঁড়ের শব্দ। পাল তুলে বিদেশির জাহাজ রওনা হবে নির্দোষ হতভাগ্য মানুষগুলোকে নিয়ে। খোলের ওপরের ছিদ্রপথে ফেলে দেয়া হবে অন্ন। কুড়িয়ে খাবে হতভাগ্য বন্দিরা। কল্পনা নয়, আমাদের পূর্ব পুরুষের বেদনামর ইতিহাস।
ভালো করে, খুব ভালো করে তাকাও। ঘন অন্ধকারের ওপারে অস্পষ্ট একটা ছবি। শতাব্দীর নৈঃশব্দ ভেদ করে ক্ষীণ ভেসে আসছে অনেকগুলো দাঁড়ের ঝপাঝপ শব্দ। আমাদের বড় আদরের পূর্বপুরুষ ঐ চলে যাচ্ছে বিদেশির ক্রীতদাস হয়ে চিরকালের জন্য, বড় কষ্টে, বড় যন্ত্রণায়। নিকষ অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে জাহাজটা।
আন্তর্জাতিক বাঙালি ব্যবসায়ী চাঁদ সওদাগরের সমুদ্র গামী বারোশ’দাঁড়ের গর্বিত ময়ূরপঙ্খীর নাম ছিল “মধুকর”।
এ জাহাজ “মধুকর” নয় …………….
পাদটীকা:- ১৬২৫ সালে মগরাজ থিরি থুডামার ঢাকা পর্যন্ত জয় করেছিল এবং ব্যাপকহারে গণহত্যা করে বিপুলসংখ্যক বাঙালিকে ধরে নিয়ে ক্রীতদাস করে রেখেছিল। ১৬৩৮ সালে থুডামারের মৃত্যুর পর মগদের মধ্যে গৃহযুদ্ধজনিত বিশৃঙ্খলার সুযোগে যে সব বাঙালি চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে আসে, তার সংখ্যাই ছিল কমবেশি দশ হাজার।
সাধারণ সম্পাদক- মুসলিমস ফেসিং টুমরো- ক্যানাডা
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।