কাজী জাফর আর নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রকাশ : ২৭ আগস্ট, ২০১৫
প্রিন্টঅঅ-অ+
জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ ইন্তেকাল (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন) করেছেন। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত সহকারী কামরুজ্জামান রনি এ তথ্য জানান।
কামরুজ্জামান রনি বলেন, কর্মীসভায় অংশ নিতে আজ বৃহস্পতিবার সকালে কাজী জাফরের কুমিল্লা যাওয়ার কথা ছিল। সকাল পৌনে সাতটার দিকে তাঁর সাড়া না পেয়ে তাঁকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
পরিবারের বরাত দিয়ে কাজী জাফরের ব্যক্তিগত সহকারী বলেন, ৭৬ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ডায়াবেটিস ও কিডনিসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তিনি গুরুতর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কাজী জাফরের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অপর এক বার্তায় কাজী জাফর আহমেদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী মমতাজ বেগম, তিন মেয়ে কাজী জয়া আহমেদ, কাজী সোনিয়া আহমেদ ও কাজী রুনা আহমেদসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও কর্মী রেখে গেছেন।
ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে রাজনীতি অঙ্গনে প্রবেশ এই নেতার। ১৯৫৫ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে তিনি রাজনীতিতে যোগদান করেন। রাজশাহী জেলা ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক এবং রাজশাহী কলেজ সাহিত্য মজলিশের মুখপাত্র, সাহিত্যিকীর সম্পাদক হিসেবে তার কর্মময় রাজনীতিতে পদচারণা শুরু করেন।
১৯৩৯ সালের ১ জুলাই কুমিল্লার প্রখ্যাত চিওড়া কাজী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি খুলনা জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও এম এ (ইতিহাস) পাস করেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এম এ এবং এল.এল.বি. কোর্স সম্পন্ন করা স্বত্ত্বেও কারাগারে চলে যাওয়ায় পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারেননি।
কাজী জাফর আহমদ ১৯৫৯-১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৬২-১৯৬৩ সালে অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (এপসু) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন ও শরীফ শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে কাজী জাফর আহমদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র জীবন শেষে তিনি শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭২-১৯৭৪ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তখন ছিলেন ন্যাপের চেয়ারম্যান।
এরপর ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনাইটেড পিপলস্ পার্টির (ইউপিপি) প্রথমে সাধারণ সম্পাদক ও পরে চেয়ারম্যান হিসেবে সক্রিয়ভাবে পার্টির সাংগঠনিক দায়িত্ব ও জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী পরিষদের শিক্ষামন্ত্রী হন।
১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির জন্মলগ্ন থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬-১৯৯০ সালে তিনি জাতীয় পার্টির সরকারে পর্যায়ক্রমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বন্দর-জাহাজ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক উপদেষ্টা, ১৯৮৯-১৯৯০ সালে বাংলাদেশের অষ্টম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৬-১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের উপনেতা ও ১৯৮৯-১৯৯০ সালে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের নেতা ছিলেন। ১৯৮৬-১৯৯৬ পর্যন্ত পরপর তিনবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তিনি সে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
১৯৮৫ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে সাত দলভুক্ত ইউপিপির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় কাজী জাফর এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘স্বৈরাচারী এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাব না।’ টেনেহিঁচড়ে এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামানোরও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। এর আগে সুনামগঞ্জ বিএনপির নেতা ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে ‘এরশাদের গোয়ালে আরেকটি রাম ছাগল যোগ দিয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন কাজী জাফর। ওই বক্তব্যের পরদিনই সেই ‘গোয়ালে’ই যোগ দেন কাজী জাফর।
১৯৮৮ সালে বন্যার্ত মানুষের জন্য বিদেশ থেকে আসা কোটি কোটি টাকার চিনি বাজারে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে কাজী জাফরের বিরুদ্ধে। মন্ত্রী থাকার সময়ে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের দায়ে ১৯৯৯ সালে ১৫ বছরের সাজা হয়েছিল তাঁর।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর কারাবন্দী থাকা অবস্থায় জামিন নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন কাজী জাফর। পরবর্তী সময় সেখানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়ায় সে দেশের গণমাধ্যমের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল অস্ট্রেলীয় সরকার। শরণার্থী হয়ে পাক্ষিক ৩৭০ ডলার ভাতাও পেতেন তিনি।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।