ছাতকে লাফার্জ-সুরমার বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ
ছাতকে সুরমা নদীতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা তথা নিজেদের বাঁচার দাবীতে লাফার্জ-সুরমার অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন এলাকাবাসী। বেসরকারি সিমেন্ট কোম্পানী লাফার্জ-সুরমার অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধের দাবীতে কারখানা সংলগ্ন এলাকা ও কারখানার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ স্থানীয় ১০/১৫টি গ্রামের মানুষ সম্প্রতি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে আন্দোলনের পরবর্তী ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। পরিবেশ রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত লাফার্জ সুরমার বিরুদ্ধে তাদের এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে তারা জানিয়েছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, সুরমা নদীর তীর থেকে প্রায় ৫০ গজ অভ্যন্তর পর্যন্ত নদী দখল করে জেটি নির্মান করা হয়েছে। এ ছাড়া কনভেয়ার বেল্টের দ্বারা শব্দ দুষণ, ডাস্টের ছড়াছড়ি, নির্বিচারে ফসলী জমি ও টিলা কেটে মাটি সংগ্রহসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষণের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কোম্পানীর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ভূক্তভোগী এলাকাবাসী স্থানীয় প্রশাসনসহ পরিবেশ অধিদপ্তরে বিভিন্ন সময় লিখিত অভিযোগ করেছেন।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর অভিযোগ, কোম্পানীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমার নদীর প্রায় ৫০গজ নদীপথ দখল করে জেটি নির্মাণ করায় নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে এখানে চর পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এছাড়া লাফার্জের মাটি, সিমেন্ট ও কেমিক্যালের ডাস্ট যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ায় এলাকার সবুজ গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেছে। কনভেয়ার বেল্টের বিকট শব্দে মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বিশেষ করে বিকট শব্দের কারনে এলাকার বিভিন্ন মানুষের কানের বিভিন্ন ধরনের অসুখ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে কানের পীড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশী। পাশাপাশি গত কয়েক বছর থেকে কাঁচামালের জন্য অবাধে কৃষি জমি ও টিলা কাটার ফলে কৃষি ও পরিবেশ হুমকীর মুখে পড়েছে। এর কুপ্রভাব বেশী করে শিশুদের উপর পড়ছে। ফলে নানা রোগে ভুগছেন এলাকার শিশুরা।
লাফার্জ কর্তৃক পরিবেশ দূষনের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী বার বার সোচ্চার হলেও কোন এক অদৃশ্য শক্তির জোরে এসব আমলে নিচ্ছেনা লাফার্জ কর্তৃপক্ষ। ভুক্তভোগী মানুষের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে গিয়ে পরিবেশ দূষণের চিত্র দেখে হতবাক হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের দাখিল করা এসব তদন্ত প্রতিবেদন পরবর্তীতে গায়েব হয়ে গেছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।
২০১৪ সালে স্থানীয় এলাকাবাসীর পক্ষে মো. আইনুল আহমদ নামে এক ব্যক্তি লাফার্জ সুরমা কর্তৃক পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে অভিযোগের সত্যতা তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সরেজমিনে কারখানার আশপাশ গ্রাম পরিদর্শণ করে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন তৈরী করে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জমা দেন।
জানা যায় প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানার আশপাশ এলাকার কৃষি জমি পরিদর্শণ করতে গিয়ে বিরান ভুমি ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি। বিভিন্ন গ্রামের ফলজ গাছসহ গাছপালা পরিদর্শণ করে দেখা যায়, লাফার্জ প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোন ফলজ গাছে ফল আসেনি এবং সব সবুজ বৃক্ষ গুলো মরে যাচ্ছে।’ কারণ হিসেবে কৃষি কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, লাফার্জের বিষাক্ত ডাস্ট গাছের পাতায় পড়ার কারনে একটি আবরণ তৈরী করে গাছের সালোকসংশ্লেষনে বাধা প্রদান করছে। এ ছাড়া আরো বিভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করে তিনি প্রতিবেদন তৈরী করে লাফার্জের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠান। কিন্তু এর পর লাফার্জের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে এবার নদী, পরিবেশ ও নিজেদের বাঁচার দাবী নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন কয়েক হাজার মানুষ।
জানা যায়, ছাতকের নোয়ারাই এলাকায় সুরমা নদীর তীরবর্তী ২শ’ একর ভূমির ওপর ২হাজার সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি। স্থানীয় মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার অঙ্গিকার নিয়ে ২০০৬ সালে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যায় লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা। এলাকাবাসীর অভিযোগ লাফার্জ তাদের অঙ্গীকার রক্ষায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে কারখানার প্রধান কাচামাল চুনাপাথর সরাসরি ছাতকে আনার জন্য ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ স্বয়ংক্রিয় একটি কনভেয়ার বেল্ট স্থাপন করা হয়। বেল্টের ১০ কিলোমিটার বাংলাদেশে ও বাকি ৭ কিলোমিটার ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত।
কিন্তু উৎপাদনে যাবার ৭মাসের মাথায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকায় ভারতের একটি এনজিও কর্তৃক ভারতে মামলা দায়ের করলে মেঘালয় থেকে কারখানার প্রধান কাঁচামাল চুনাপাথর আমদানী বন্ধ হয়ে পড়ে। ভারতের উচ্চ আদালতে মামলার কারণে ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে কোম্পানিটির ক্লিংকার উৎপাদন কার্যক্রম সর্বমোট প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল। তবে ২০১১ সালের আগস্টে ভারতের আদালত চুনাপাথর রপ্তানীর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে ওই বছর থেকে ফ্যাক্টরীতে সিমেন্ট উৎপাদন কার্যক্রম আবার শুরু হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানার অভ্যন্তর থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ননগোট্রাই খনি পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সক্রিয় কনভেয়ার বেল্ট যা ছাতক-দোয়ারার বিভিন্ন গ্রাম, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনবহুল এলাকার পাশ দিয়ে চলে গেছে। ভূমি থেকে বেল্টের উচ্চতা খুব বেশী নয়। ফলে বেল্টে বিশেষ পদ্ধতিতে সংযুক্ত বক্সের মাধ্যমে ভারত থেকে চুনাপাথর বহনের জন্যে বেল্ট চালু করলে বিকটভাবে শব্দ শুরু হয়। বিশেষ করে যে সকল বাড়িঘরের পাশ দিয়ে বেল্ট চলাচল করে সেইসব এলাকার লোকজনের স্বাভাবিক জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ফলে অন্তত ৩০টি গ্রামসহ জনবহুল এলাকার মানুষ উচ্চ শব্দ বিশিষ্ট কনভেয়ার বেল্টের কারণে শব্দ দূষণে ভুগছেন। ভারি শিল্প কারখানায় ডাস্ট ডিভাইডার ব্যবহারের বিধান থাকলেও লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানায় এ ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
লাফার্জের ডাস্ট ছড়িয়ে পড়ায় এলাকার নোয়ারাই, টেংগারগাঁও, জয়নগর, বারকাহন, বাতিরকান্দি, টিলাগাঁও, শারপিননগর, মফিজনগর, জুড়াপানি, মৌলা, বন্দরগাঁও, সিংগের কাছ, কালাপাশি, বড়ময়দান, ডগারপাড়সহ বেশ ক’টি গ্রামের সবুজ গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেছে। লাফার্জের কেমিক্যাল মিশ্রিত ডাস্টে ক্ষতিগ্রস্থ’ হচ্ছে ঘর-বাড়ির ছাদ ও টিনের চালা। দরজা বন্ধ করেও ডাস্টের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেননা এলাকার মানুষ।
জানা যায়, সিমেন্ট উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল মাটি সংগ্রহ করতে লাফার্জের আবেদনের প্রেক্ষিতে কৃষি জমির ৬ ইঞ্চি টপসয়েজ অপসারণ করে পুনরায় অপসারিত টপসয়েজ জমিতে ফেলার শর্তে মাটি সংগ্রহের অনুমতি দেয় সরকার। কিন্তু শর্তের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে ফসলী জমি ধ্বংস করে এবং পাহাড় কেটে মাটি সংগ্রহ করছে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখান।
নোয়ারাই এলাকার অ্যাডভোকেট আশিক আলী অভিযোগ করেন, স্থানীয়ভাবে ফসলী জমি থেকে মাটি সংগ্রহ করতে আকর্ষনীয় মুল্যে ঠিকাদার নিয়োগ করে লাফার্জ কর্তৃপক্ষ। জমির ক্ষতি না বুঝে সাময়িক অর্থের লোভে স্থানীয় কৃষকরা ঠিকাদার ও দালালদের কাছে ফসলী জমির মাটি বিক্রি করে। এভাবে প্রতি বছর ঠিকাদারের মাধ্যমে লাখ-লাখ মেট্রিকটন মাটি সংগ্রহ করায় নোয়ারাই ইউনিয়নের কয়েক হাজার হেক্টর ফসলী জমি ইতিমধ্যেই মাছ চাষেরও অনুপযোগী জলাশয়ে পরিনত হয়েছে।
লাফার্জ কর্তৃক সুরমা নদী দখলের চিত্র সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীর তীরবর্তী এই কারখানা থেকে মালামাল কার্গোতে বোঝাই করার জন্য সুরমা নদীর প্রায় শ’ দেড়েক গজ অংশে বিশাল আকারের পাকা পিলার নির্মাণ করে জেটি স্থাপন করেছে লাফার্জ। জেটির চারপাশে অনেকগুলো কার্গো দেখা যায়। এ কার্গোগুলোতে সিমেন্ট বোঝাই হচ্ছে। পাকা পিলার পুতে নদীর বিশাল অংশ দখল করে জেটি নির্মাণ করায় নদীর স্রোত এখানে এসে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে নদীর এই অংশটি পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে বলেও জানান স্থানীয়রা।
এদিকে লাফার্জের কারনে স্থানীয় ভুমি ক্ষতিগ্রস্থদের সংগঠণ ‘পেপস কমিউনিটি’-এর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, স্থানীয়দের চাকুরী এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নে লাফার্জ যে সমস্ত কর্মসূচি পরিচালনা করার কথা ছিল, লাফার্জ সে অঙ্গীকার রক্ষায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নে কর্মসূচি পরিচালনার কথা থাকলেও এসব নিয়ে লাফার্জ এর কোন মাথা ব্যাথা নেই। এলাকাবাসী এ নিয়ে অনেক অভিযোগ ও আন্দোলন করেও কোন লাভ হচ্ছেনা। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের কোঅর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা বলেন, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয় এ ধরনের কিছু নির্মাণ করা বেআইনী। তা ছাড়া নদীর স্রোত বাধাগ্রস্থ হওয়ার কারণে পলি পড়ে চর জেগে উঠলে নদীর নাব্যতাও ব্যাহত হয়।
সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদুল্লাহ শহিদুল ইসলাম জানান, নদী হলো সরকারি সম্পত্তি, কোন বেসরকারি কোম্পানী নদী দখল করলে সরকারি সম্পত্তি দখল ও পরিবেশ নষ্টের জন্য অভিযুক্ত হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম জানান, ছাতকে লাফার্জ-এর পরিবেশ দূষণ নিয়ে স্থানীয়ভাবে আন্দোলন হবার খবর শুনেছি। তবে সুরমা নদী দখলের বিষয়টি বাপা গুরুত্ব সহকারে দেখবে বলে জানান তিনি।
এব্যাপারে লাফার্জ সুরাম সিমেন্ট কারখানার পাবলিক রিলেশন অফিসার তৌফিক ইমাম জানান, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা আন্তর্জাতিক একটি কোম্পানী। পরিবেশ রক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে লাফার্জ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কাজ করছে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।