‘সেন্সরশিপ জিনিসটা অন্যায়’
(১) কথাটা স্পষ্ট করে বলতে চাই। বহুবার বলেছি, বহুদিন ধরে বলছি আবার বলি। আমি সকল প্রকার সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে। যদি বুঝে না থাকেন সেইজন্যে আরেকবার বলি- আমি মনে করি সেন্সরশিপ জিনিসটা অন্যায়। সকল সেন্সরশিপ অন্যায়। সমাজ বা রাষ্ট্রের কোন নৈতিক অধিকার নাই আমি কি দেখব কি পড়ব বা কি শুনব সেটা নির্ধারণ করে দেওয়ার। আমি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ, আমার যেটা ভাল লাগে সেটা আমি দেখব, আমার যেটা ভাল লাগে সেটা আমি বলব, আমার যেটা ভাল লাগে সেটা আমি পড়ব বা শুনব। কার বাপের কি।
আমাদের নায়করাজ রাজ্জাক আর পরিচালক শহিদুল হক খান পাঁচজন সচিব আর উপসচিব জাতীয় লোককে নিয়ে বসে নির্ধারণ করে দিবে কোন সিনেমা আমার জন্যে দেখা উচিৎ আর কোনটা উচিৎ না? না, রাজ্জাক বা শহিদুল হক খানের প্রতি আমার কোন অসম্মান নাই। কিন্তু এই লোকগুলির নৈতিক জ্ঞান আর রুচির উপর নির্ভর করবে আমি কোন সিনেমা দকেহতে পারবো আর কোনটা দেখতে পারবো না? কেন? আমি কি নাবালক?
আমাদের রাষ্ট্র আমাদেরকে এই অপমানটা করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এই যে আমাদের দেশে সেন্সর বোর্ড নামের একটা জিনিস আছে ওরা নাকি আমাদের মরাল গার্জেন। রাজ্জাক আর শহিদুল খান সেন্সর বোর্ডের মেম্বার আর সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান হচ্ছে একজন সচিব। ওদের মাপে আমার নৈতিকতার বা রুচির মান ঠিক করতে হবে? এটা অন্যায়। অনেকদিন ধরে হয়ে আসছে এই অন্যায়টা। আমাদের রাষ্ট্র নাগরিকদেরকে মনে করে নাবালক, আবাল। আমরা নাকি সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ।
সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে যে আমাদের দেশের শিক্ষিত বিদ্যান মানুষদের বেশিরভাগই মনে করে যে দেশের সিনেমা গান নাটক খবর সাহিত্য এগুলি নাকি সেন্সর করা দরকার। এতেই নাকি দেশের জন্যে ভাল। যতসব ডিগ্রীওয়ালা মূর্খের দল। ঔপনিবেশিক দাস মনোবৃত্তি নিয়ে বসে আছে সব। নিজেকে মনে করে সাহেব আর দেশের বাকি সব 'সাধারণ মানুষ' 'নেটিভ'।
(২) লিবার্টি নামে একটা জিনিস শব্দ আছে। আপনি যখন ফেসবুকে এইসব লেখা পড়তে পারছেন তখন ধরে নিতেই পারি যে আপনি শব্দটা শুনেছেন। মানুষের লিবার্টি ফেলনা জিনিস না। এটা আমার অধিকার। আমার অধিকার সমাজ বা রাষ্ট্র খর্ব করতে পারে কেবল তখনই যখন আমার কাজে অপরের ক্ষতি (harm) হবার সম্ভাবনা থাকে। অপরের হার্ম করা ছাড়া আমি আমার যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। এই লিবার্টির স্বীকৃতি বা গুরুত্ব যেই সমাজ দেয় না বা মানে না সেই সমাজ সভ্য সমাজ না।
উপরে যে কথাগুলি বললাম, সেগুলিই ঠিক। আমি তাই মনে করি। আপনি চাইলে এর পক্ষে আমি সকল জুরিস্প্রুডেনশিয়াল বা ফিলজফিক্যাল যুক্তি তর্ক তত্ব জুড়ে দিয়ে বিশাল প্রবন্ধ দাড় করাতে পারি। কিন্তু তার কোন প্রয়োজন দেখি না। এইগুলি তর্ক মিল সাহেব করে গেছেন (J S Mill), আরও অনেকে করেছেন। মিল সাহেবের বিপক্ষেও অনেকে বলেছেন। এখন ইন্টারনেটে এইসব কিতাব ফ্রিতে পাওয়া যায়, পড়ে নিতে পারেন।
ঐ হার্ম ঠেকানো ছাড়া মানুষের লিবার্টিতে হাত দেওয়ার কোন যুক্তি নাই। যারা এটা বুঝেন না, ওদের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নাই, মানুষকে সম্মান করে না। আর জানেনই তো, কেবল নিচু মাত্রার মানবিক বোধওয়ালারাই অপরকে সম্মান করতে পারেনা। আমাদের অসুবিধা হচ্ছে আমাদের ডিগ্রীওয়ালা লোকগুলি আমাদেরকে শ্রদ্ধা করতে শিখেনা। সেকারণেই আমাদেরকে নাবালক মনে করে। মনে করে যে একটা সিনেমা আমি দেখতে পারবো কি পারবো না, উচিৎ হবে কি হবেনা সেটা ওরা ঠিক করে দিতে হবে। আমার নাকি সেই বিবেক বুদ্ধি নাই।
ভাবলেই তো ইচ্ছা করে শালার লাত্থি মেরে ভেঙ্গে দেই এই সেন্সরপছন্দওয়ালা হামবাগদের ঘাড়।
(৩) না, শিশু আর অপ্রাপ্তবয়স্ক আর যারা ক্লিনিক্যালি ইয়ে ওদের কথা আলাদা। সেজন্যে রেটিং করতে পারেন। যে না, এই ছবিটা ১৮ বছরের নীচে কেউ দেখা ঠিক হবেনা। বা সেরকম কিছু। কিন্তু আমি একটা সিনেমা বানালাম আর আপনি সেটা দেখার আগে ঐ সচিব গংদের কাছ থেকে এনওসি নিয়ে আসতে হবে এইটা চলবে না। কন্টেন্ট কাটাকাটি করবেন? কভি নেহি। সেটা অন্যায়।
(৪) আর যারা এই বিষয়টা নিয়ে আগে কখনো ভাবেননি, সেন্সরশিপ উঠে গেলে কি ভয়াবহ কাণ্ড হয়ে যাবে এই ভেবে যদি আপনি আঁতকে উঠেন, তাইলে বলি, আস্তে। মাথা ঠাণ্ডা করেন। একটা দম নেন। তারপর চিন্তা করেন।
আজকে যদি আমাদের সেন্সরশিপের আইনটা উঠে যায় আর সরকারের কাজ যদি হয় শুধু রেটিং করে দেওয়া তাইলে কি হবে? সিনেমার কথা ভাবেন। কি হবে? ঘোড়ার ডিমের খারাপ কিছুই হবে না।
আপনি কি মনে করেছেন সেন্সরশিপ উঠে গেলে সবাই অশ্লীল সিনেমা বানানো শুরু করে দিবে? ভুল। শ্লীল অশ্লীল সংজ্ঞার সেই তর্কে গেলাম না। অশ্লীল দৃশ্য থাকলেই ছবি বেশী চলে না। পৃথিবীর বহু দেশে পর্নোগ্রাফি উম্মুক্ত। সিনেমা হলে হার্ডকোর পর্নো মুভি দেখানো হয়। আপনি টিকেট কেটে দেখতে পারেন। বয়স চেক করবে শুধু। সেইসব সিনেমা হলে মানুষ যায় খুবই কম। সেইসব সিনেমা হল থাকে ছোট ছোট, কেননা মানুষ যায় কম।
আমাদের দেশেও এটা পরিক্ষিত। কেবল অশ্লীল দৃশ্য দিয়ে সিনেমা চলে না। আপনি যদি মনে করে থাকেন যে তিনটা ন্যাংটা নাচ ঢুকিয়ে দিলেই দুনিয়ার সব রিকশাওয়ালা লাইন ধরে গিয়ে সেটা দেখবে ভুল করবেন। যারা দেখবে ওদেরকে নিয়ে হয়তো তিনদিন বা এক সপ্তাহ সিনেমা চলবে। এইগুলি পরীক্ষা আমাদের দেশেই হয়ে গেছে বহু আগে।
আরো ইন্টারেস্টিং তথ্য পাবেন খুঁজলে। যেসব দেশে সেন্সরশিপ নাই, ব্লু ফিল্ম দেখা যায়, খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন সেইসব দেশে ধর্ষণ বা শিশুর উপর নির্যাতন সেন্সরওয়ালা দেশের চেয়ে কম। বাজি ধরতে পারেন।
(৫) সেন্সরশিপ আসলে একটা রাজনৈতিক ব্যাপার। এখানে মানুষের ভাল মন্দের কিছু নাই। এটা একটা রাজনৈতিক ব্যাপার। রাষ্ট্রে যদি সর্বাত্মক গণতন্ত্র না থাকে তাইলে রাষ্ট্র অনেক সময় একটা কর্পোরেট ক্যারেক্টার ধারণ করে, আর রাষ্ট্রের মানবিক আবেগ এবং নাগরিকদের মর্যাদা তখন চাপা পড়ে যায়। সেইধরনের রাষ্ট্রেই এইসব সেন্সরশিপ আর মরাল পুলিশিং এইসব বেশী চলে। আমার মধ্যবিত্ত ভাল মানুষেরা সেই হেজিমনিতে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে সেন্সরশিপের মত বিকৃত জিনিসের মধ্যে ভালগুন দেখতে পায়।
(৬) কথাগুলি বলছি কারণ সম্প্রতি ভারতে পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট বন্ধ করার পর আমাদের এখানে যে প্রতিক্রিয়া দেখছি তাতে খুব বিরক্ত হয়েছি। আপাত ভালমানুষ, লিবারেল ধরনের লোকজনকেও দেখি ওয়েবসাইট বন্ধের পক্ষে বলছেন। শুধু তাই না। যারা এটার সমালোচনা করছেন ওদেরকে গালাগালি করছে।
কি অদ্ভুত ব্যাপার। যিনি লিবার্টির পক্ষে বলছেন তাকেই গালি দিচ্ছেন আবার নিজেকে বলছেন লিবারেল মুক্তমনা। কৌতুক আরকি!
লেখক: ইমতিয়াজ মাহমুদ
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।