- হোম
- >
- বায়োগ্রাফি
- >
- সৈয়দ হাসান ইমাম
সৈয়দ হাসান ইমাম
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রকাশ : ২৫ জুলাই, ২০১৫
প্রিন্টঅঅ-অ+
সৈয়দ হাসান ইমাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ২৭ জুলাই বর্ধমানের ২ নং পার্কাস রোডের মামাবাড়িতে। তাঁর পিতা সৈয়দ সোলেমান আলী এবং মাতার নাম সৈয়দা সইদা খাতুন। বর্ধমানের মামাবাড়িতেই তাঁর শৈশব কাটে। এই বাড়িটি ছিলো রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। একটি রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে সৈয়দ হাসান ইমাম বড়ো হন। তাঁর বড়ো মামা সৈয়দ শাহেদুল্লাহ ও মেজো মামা সৈয়দ আবুল মনসুর হাবীব উল্লাহ ছিলেন সন্দ্বীপের কমরেড মোজাফ্ফর আহাম্মদের অনুসারী।
পশ্চিম বঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাঁদের অবদান অপ্রতিম। সৈয়দ শাহেদুল্লাহ পরবর্তী সময়ে দিল্লীতে রাজ্যসভার সদস্য হন এবং সৈয়দ আবুল মনসুর হাবীব উল্লাহ পর্যায়ক্রমে কোলকাতার সংসদের স্পীকার এবং আইন ও সংখ্যলঘু বিষয়ক মন্ত্রী হন। সৈয়দ হাসান ইমামের নানা আবুল হাশিম ছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক। বর্ধমানের এই বাড়িতে রাজনৈতিক নেতাদের আসাযাওয়া ছিলো নিয়মিত। লিয়াকত আরী খাঁন, খাজা নাজিম উদ্দিন, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ. কে. ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তমিজউদ্দিন খান, শামসুল হক, কমরেড মোজাফ্ফর আহাম্মেদ, ভবানী সেন, বঙ্কিম মুখার্জী, সরোজ মুখার্জী, বিনয় ঘোষ, জ্যোতিবসু, মনিকুন্তলা সেন, অশ্রু হালিম, মৃণাল সেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শে সৈয়দ হাসান ইমামের শৈশব অতিবাহিত হয়।
তাঁর স্কুল জীবন শুরু হয় বর্ধমান টাউন স্কুলে। স্কুল জীবনেই তিনি প্রত্যক্ষ করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব। জাপানি বোমার ভয়ে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের উপর দিয়ে পলায়নপর হাজার হাজার মানুষের ঢল তিনি দেখেছেন। খুব ছোটোবেলাতেই দেখেছেন ১৯৪২ এর ‘ব্রিটিশ ভারত ছাড়’ আন্দোলন, দেশজুড়ে ইংরেজ শাসনের দমননীতি, তেতাল্লিশের মনন্তর, ছেচল্লিশের দাঙ্গার বিভৎসতা। এইসব বাস্তবতা আর মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের পথে তিনি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো সঞ্চয় করেছেন। বড়ো হয়ে উঠেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন স্কুল জীবনেই। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আসেন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট বেল সাহেব।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ হাসান ইমাম অন্যান্যদের সঙ্গে প্রতিবাদ ‘ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে পুরস্কার নেবো না’ শ্লোগান দিয়ে বেরিয়ে আসেন অনুষ্ঠান থেকে। শৈশবেই তিনি আরেকটি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, তখন তাঁর বয়স ছিলো নয় বছর। সুভাসচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে সকল ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আইএনএ- এর (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে তখন বিচার করা হচ্ছে। বিচার করছে লালকেল্লা। রশিদ আলীর বিচার যেদিন হচ্ছে সেদিন পুরো ভারতবর্ষ উত্তাল হয়ে পড়ে। সৈয়দ হাসান ইমাম তখন স্কুল থেকে এই আন্দোলনে যোগ দিলেন। ‘বিচার বন্ধ করতে হবে’- এই শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লেন নয় বছরের শিশু হাসান ইমাম। পুলিশের লাঠিচার্জের শিকারও হলেন নির্মমভাবে।
খেলাধূলার প্রতি ছিলো তাঁর অদম্য ঝোঁক আর ঈর্ষণীয় পারদর্শিতা। সে সময় পাঁচটা ফরোয়ার্ড নিয়ে ফুটবল খেলা হতো, তিনি খেলতেন রাইট ইন- এ। স্কুল জীবনে ‘বেঙ্গল স্কুল’- এর হয়ে তিনি খেলেছেন। তাঁর সঙ্গে খেলতেন চুনি গোস্বামী (পরবর্তী সময়ে ভারতের জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন)। ‘বেঙ্গল স্কুল’- এর বিরুদ্ধে ‘বিহার স্কুল’- এর খেলা হতো প্রায়ই। সেখানে খেলতেন পি. কে. ব্যানার্জী (তিনিও ভারতের জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন ও কোচ হয়েছিলেন পরবর্তী জীবনে)। কিন্তু পা নষ্ট হয়ে যাবার পর তিনি ফুটবল খেলা ছেড়ে দিলেন। ক্রিকেট খেলতেন, খেলেছেন কোলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের টীমে ওপেনিং ব্যাটসম্যান এবং উইকেট কিপার হিশেবে। ঢাকায় এসেও তিন বছর ফার্স্ট ডিভিশন লীগে খেলেছেন।
১৯৫২ সালের ম্যাট্রিক পাশ করার পর বর্ধমান পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং- এ পড়াশুনা করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এসময় তিনি গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে কিছুদিন বসবাস করেন। সৈয়দ হাসান ইমামের অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৫০ সালে, যখন তিনি বর্ধমানে কলেজে ভর্তি হন।
কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে নাটক মঞ্চস্থের সময় তিনি প্রথম অভিনয় করেন। একই দিনে মঞ্চস্থ দুটো নাটকে তিনি নায়ক ও নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। একটি ছিলো ‘মিশরকুমারী’ নাটক, এটাতে তিনি নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন; অন্যটি বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘দায়িত্ব’ নাটক, এটিতে তিনি নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর থেকেই অভিনেতা হিশেবে তিনি পরিচিতি লাভ করতে লাগলেন। দেশে ফেরার পর ১৯৬০ সালে তিনি রেডিওতে যোগ দিলেন। একই সঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করতে শুরু করলেন। বর্ধমানে থাকতেই তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক তালিম ছাড়াই তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও স্কুলের প্রতিযোগিতায় গান গাইতেন। এক রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন, ওই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। পরে গলায় ফ্যানিনজাইটিস ধরা পড়ায় তিনি আর সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত রাখেননি।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনে বাধা দেয় পাকিস্তান সরকার। ফুঁসে ওঠে সমগ্র বাংলার মানুষ। ষৈয়দ হাসান ইমাম তখন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে কর্মরত। সরকারি চাকুরিতে থাকা অবস্থাতেও তিনি আন্দোলনে যোগ দিলেন। তখন ড্রামা সার্কেলের উদ্যোগে তাসের দেশ, রাজা ও রানী ও রক্তকরবী- এই তিনটি নাটক হয়। তিনটি নাটকেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন সৈয়দ হাসান ইমাম। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, মানুষের মাঝে সাংস্কৃতিক চেতনার উদ্বোধন ঘটিয়ে সম্প্রীতি ও মৈত্রী স্থাপনের কাজ করেছেন।
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। দুঃস্থ শিল্পীদের জন্য দুঃস্থ শিল্পী কল্যান ট্রাস্ট গঠন করেন। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের মহাপ্লাবনের সময় তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠে ‘দুর্যোগ নিরোধক আন্দোলন কমিটি’।
চলচ্চিত্র সৈয়দ হাসান ইমামের জীবনের একটি বড়ো অধ্যায়। একদিকে যেমন অভিনয় করেছেন, তেমনি করেছেন চলচ্চিত্র পরিচালনা। তাছাড়া টৈলিভিশন নাটকেও তিনি সমান ঋদ্ধতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। ১৯৬০ সালে তিনি চলচ্চিত্র এবং ১৯৬৪ সালে তিনি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শুরু করেন। তাঁর অভিনীত জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজা এলো শহরে, শীত বিকেল, জানাজানি, ধারাপাত ইত্যাদি। অনেক দিনের চেনা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার অর্জন করেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিশেবে তিনি কাজ করতে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই। দেশ স্বাধীনের পর তিনি ফিরে আসেন বাংলাদেশে এবং দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সোচ্চার ছিলেন মুক্তবুদ্ধি চর্চা আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ‘শিল্পকলা একাডেমি’ প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃৎ ভূমিকা পালন করেন।
সবসময়ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এবং জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সৈয়দ হাসান ইমাম একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে গণ-আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই আন্দোলনের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন এবং তার বিভিন্ন কাজের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছেন সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায়। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সভাপতি হিশেবে। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে যে নারকীয় বোমা হামলা ঘটানো হয়, তাতে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। আহত সহযোদ্ধাদের জন্য তিনি এখনও কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৯৯ সালে শিল্প সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক লাভ করেন।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।