- হোম
- >
- বাংলা ও বাঙালি
- >
- সমাজ পরিবর্তনের পুরোধা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ
সমাজ পরিবর্তনের পুরোধা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রকাশ : ০৫ জুলাই, ২০১৫
প্রিন্টঅঅ-অ+
মোহাম্মদ ফরহাদ মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য।
জন্ম ও পরিবার
কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আহমেদ সাদাকাতুল বারি এবং মাতার নাম মরহুমা তৈয়বুন্নেসা।
শিক্ষা জীবন
দিনাজপুর জিলা স্কুল সংলগ্ন একটি প্রাইমারী স্কুলে চল্লিশের দশকের শুরুতে মোহাম্মদ ফরহাদ এর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তিনি দিনাজপুর জেলা স্কুলের একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে সর্বদাই পরিচিতি ও প্রশংসিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি প্রবেশিখা পরীক্ষায় ভালভাবে উত্তীর্ণ হন এবং দিনাজপুরের তদানিন্তন একমাত্র কলেজ দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে আই.এ পাস করেন।
১৯৫৯ সালে তিনি সুনামের সাথে বি.এ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাস করেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যকলাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ স্থান লাভ করেন। ১৯৬২ সালে আইন অধ্যয়নরত অবস্থায় আইয়ুব খান ফরহাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া বের করে।
ছাত্র আন্দোলন
মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৫২ সালে মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে দিনাজপুর জেলা স্কুলের ছাত্র হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের পরপরই এদেশের ছাত্র সমাজের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন' ঢাকায় গঠিত হলে দিনাজপুর জেলায় ঐ সংগঠনের মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯৫৩-৫৪ সালে বোদা-পঞ্চগড় প্রভৃতি এলাকায় তিনি প্রথম ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য (কোষাধ্যক্ষ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। কমরেড ফরহাদ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পার্টির নির্দেশে কোষাধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন।
কেননা পার্টি মনে করেছিল একেবারে উপরের পদে গেলে পার্টির গোপন কাজ করতে অসুবিধা হবে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক আইনের বিরুদ্ধে যে জঙ্গি ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন সেই আন্দোলনের মূল নেতা। তাকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের 'মস্তিষ্ক' বলে অভিহিত করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একজন প্রধান বিপ্লবী ছাত্রনেতা হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র সমাজের সমাদর লাভ করেন। এই সময় হতেই তদান্তিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (তখন অসংগঠিত ও অবলুপ্ত অবস্থায় ছিল) কর্মী ও নেতৃবৃন্দ তার সংস্পর্শে আসেন।
তার সাথে পরামর্শ করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গোপনে সংগঠিত হতে থাকে। শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন কমরেড ফরহাদের সামান্য জুনিয়র। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুবের বিরুদ্ধে ঢাকার রাজপথে প্রথম মিছিল বের করতে গিয়ে তাকে পুলিশের সাথে হাতাহাতি করতে হয়েছিল। ৬০ হতে ৮০ দশক পর্যন্ত মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু। '৬৯ এর ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের তিনি ছিলেন নেপথ্য কারিগর এবং প্রকৃত পরামর্শদাতা।
রাজনৈতিক জীবন
চল্লিশ দশকের বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া ভারতের স্বাধীনতা, চীনের বিপ্লব এবং ১৯৪৮ সালের দিকে দিনাজপুরের তেভাগা আন্দোলন তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ তৈরীতে প্রভাব রাখে। এই সময়ে মোহাম্মদ ফরহাদ রাজনীতিতে প্রভাবিত হয়ে পড়েন এবং ঐ সময় হতেই মোহাম্মদ ফরহাদ সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষিত হয়ে দিনাজপুর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৫ সালে কমরেড মনি সিংহের সাথে তার প্রথম সাক্ষাত ঘটে। ঐ বছরই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।
দিনাজপুর জেলা পার্টি ১৭ বছর বয়সে বিশেষ বিবেচনায় তাকে পার্টির সদস্য পদ দেয়। ১৯৫৮ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মূল নেতা ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। অতি কিশোর বয়সে ১৯৫১ সালে মোহাম্মদ ফরহাদ দিনাজপুরের কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতৃবর্গের সংস্পর্শে আসেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ, মির্জা নুরুল হুদা কাদের বক্স ( ছোটি), অনিল রায়, দীপেন রায়, আসলেউদ্দিন, গুরুদাস তালুকদার, কম্পরাম সিং, ইন্দ্রমোহন, মির্জা আব্দুস সামাদ প্রমুখ। ১৯৬৬ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্র্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে পার্টির প্রথম কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন ও প্রভৃতি সংগঠনসমূহকে নিয়ে যে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছিল মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন এই সংযুক্ত মুক্তিবাহিনীর প্রধান সংগঠক ও নেতা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় বিশ হাজার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তিনি ছিলেন নেতা। ৩০ জানুয়ারি মোহাম্মদ ফরহাদ ঢাকা স্টেডিয়ামে এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর অস্ত্র বঙ্গবন্ধুর নিকট সমর্পণ করেন। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ৩৫ বছর বয়সে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালে জুন মাসে তদান্তিন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পার্টি বাকশাল গঠন করলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত হন এবং তাকে ঐ সংগঠনের দলীয় রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার রাজনৈতিক ছদ্ম নাম ছিল 'কবির'। তাকে বলা হত 'বাংলার লেনিন'। তার শাণিত ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিল। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার নিপুণ কারিগর। 'ঐক্য ও সংগ্রাম' ছিল তার একটি বড় কৌশল। তার ছিল সাংগঠনিক দক্ষতা ও সময়োপযোগী নির্ভুল ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। রাজনৈতিক কর্ম-কৌশল নির্ধারণে তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পেরে ছিলেন।
সিপিবি অফিসে মোহাম্মদ ফরহাদের রুমটি ছিল স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক শক্তির তীর্থ স্থানের মত। '৭০ এর নির্বাচনের পর তিনি এই বাণী দিয়েছিলেন যে, 'স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সময় আসন্ন। '৮৬ নির্বাচনের আগে স্বৈরাচারকে পরাস্ত করার কৌশল হিসেবে তিনি দিয়েছিলেন দুই নেত্রীর ১৫০-১৫০ আসনে নির্বাচন করার ফর্মূলা। ভীত হয়ে এরশাদ অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন যে কোন প্রার্থী ৫ টির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারবেন না। অনেকে তাকে 'এরশাদের যম' বলে অভিহিত করেছিল। ফরহাদ আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন '২০০০ সালের মধ্যে বিপ্লব সংগঠিত করার'। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পঞ্চগড়-২ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন।
মৃত্যুবরণ
১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর মস্কোতে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের কর্মবহুল জীবনের অবসান ঘটে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।