আজ পপগুরু আজম খানের মৃত্যুবার্ষিকী
আজ বাংলাদেশের পপগানের গুরুখ্যাত কিংবদন্তি শিল্পী আজম খানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। চার বছর আগে এই দিনটিতে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরতরে চলে যান। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে এই গুণী শিল্পী ২০১১ সালের ৫ জুন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
উল্লেখ্য, ‘বাংলাদেশ’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’ কিংবা ‘আলাল ও দুলাল’ এই গানগুলোর সুরের মূর্ছনায় যিনি আমাদের বার বার মুগ্ধ করেছেন, তিনি আজম খান৷
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কয়েক দশক তরুণদের বিনোদনের মূল খোরাক ছিল আজম খানের পপ সংগীত৷ আর এ কারণেই তাকে বলা হয় বাঙালির ‘পপগুরু’৷
মানুষের মনের কোঠায় তিনি পপগুরু বা পপসম্রাট হিসেবেই জায়গা করে নিয়েছেন৷ তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক৷ বাংলাদেশে পপ সংগীতের অন্যতম পথপ্রদর্শক তিনি৷ তার পপ আঙ্গিকের সংগীত বাংলাদেশের যুব সমাজের কাছে পেয়েছে বিপুল সমাদর৷ পশ্চিমা ধাঁচের পপগানে দেশজ বিষয় সংযোজন করে আজম খান বাংলা পপ গানের জগতে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভুত হোন।
সংগীতের প্রতি আজম খানের অনুরাগ পরিলক্ষিত হয় শৈশব থেকেই। নিজ আগ্রহ ও মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি নিয়মিত সংগীতচর্চা অব্যাহত রাখেন। আজম খানের সংগীত জীবনের শুরু ষাটের দশকের একবারে শুরুতে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত প্রচার করেন। ১৯৭১ সালের পর লাকী আখন্দ, হ্যাপী আখন্দ, নিলু, মনসুর এবং সাদেককে নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ডদল উচ্চারণ।
১৯৭২ সালে বিটিভিতে আজম খানের ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুইটি সরাসরি প্রচার হলে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে বিটিভিতে ‘বাংলাদেশ (রেললাইনের ঐ বস্তিতে)’ গান গেয়ে সারা দেশব্যাপী হৈ-চৈ ফেলে দেন আজম খান। ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ এবং পিলু মমতাজের সঙ্গেও বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তিনি। বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড-রক ঘরানার গান ‘জীবনে কিছু পাবো না’। বাংলা গানের ইতিহাসে এটিই প্রথম হার্ডরক সংগীত বলে বিবেচিত।
১৯৮২ সালে ‘এক যুগ’ নামে আজম খানের প্রথম অডিও অ্যালবাম বাজারে আসে। তার একক অ্যালবাম সংখ্যা ১৭ এবং দ্বৈত ও মিশ্র অ্যালবাম ২৫টির বেশি। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে কনসার্ট পরিবেশন করেন আজম খান৷ এসব কনসার্টে শুধু প্রবাসী বাঙালিই নয়, বহু বিদেশী সংগীতানূরাগীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি৷ বাংলা সংগীতের নানা ধারার গান পপ আঙ্গিকে গেয়েছেন আজম খান৷ তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে – বাংলাদেশ, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, আলাল ও দুলাল, অনামিকা, অভিমানী, আসি আসি বলে ইত্যাদি।
গানের জগত ছাড়াও আজম খান অভিনয় জগতে ‘গড ফাদার’ নামক একটি বাংলা সিনেমায় ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু বিজ্ঞাপন চিত্রেও মডেল হয়েছিলেন।
খেলাধুলাতেও সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন তিনি। ১৯৯১—২০০০ সালে তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতেন।
আজম খান একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। একাত্তরে মাত্র ২১ বছর বয়সে যুদ্ধে অংশ নেন আজম খান৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় সংঘটিত কয়েকটি গেরিলা অভিযানে তিনি অংশ নেন। মূলত বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ। তার নেতৃত্বে সংঘটিত ‘অপারেশন তিতাস’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অপারেশনের লক্ষ্য ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান রুপসী বাংলা হোটেল) এবং হোটেল পূর্বাণীর গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হোন। যা পরবর্তীতে তার শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়। যুদ্ধের মাঠেও থেমে থাকেনি তার সংগীত সাধনা। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ যোগাতো।
স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে হলিউড থেকে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ১৯৯৩ সালে বেস্ট পপ সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড, টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার ২০০২, কোকাকোলা গোল্ড বোটলসহ লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড অন্যতম।
আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আজিমপুরের এক সরকারি কোয়ার্টারে৷ তার আসল নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান৷ বাবা আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন সরকারের সচিবালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মা জোবেদা বেগম একজন সংগীত শিল্পী।
আজম খানের ভাই-বোনদের মধ্যে বড় ভাই সাইদ খান (সরকারি চাকরিজীবী), মেজো ভাই আলম খান (সুরকার), ছোট ভাই লিয়াকত আলী খান (মুক্তিযোদ্ধা) এবং ছোট বোন শামীমা আক্তার খানম। জন্ম-জীবনকাল-যুদ্ধ-কাজ-মৃত্যু সবমিলিয়ে তিনি পুরো জীবনটাই ঢাকায় কাটিয়েছে।
১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার মাদারটেকে সাহেদা বেগমকে বিয়ে করেন আজম খান। তখন তার বয়স ছিল ৩১ বছর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে এবং দুই মেয়ের জনক। প্রথম সন্তানের নাম ইমা খান এবং দ্বিতীয় সন্তানের নাম হৃদয় খান এবং তৃতীয় সন্তানের নাম অরণী খান।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।