ব্লগ আগে না ইন্টারনেট আগে: হেফাজত কী বলে
ধর্মানুভূতি এবং দেশপ্রেম বারংবার মুখোমুখি অবস্থান নেয় আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে। স্বাধীন হওয়ার পূর্ব থেকেই বিভিন্ন মৌলবাদী চক্র ধর্মকে পুঁজি করে চক্রান্ত করে আসছে দেশপ্রেম থেকে আমাদের দূরে সরাতে। সর্বশেষ যারা ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টি করে দেশকে বিপদের দিকে ঠেলতে চক্রান্ত চালিয়ে আসছে এমনই একটি উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠির নাম ‘হেফাজতে ইসলাম’। শাহ আহমদ শফী এই সংগঠনের আমির।
‘হেফাজতে ইসলাম’ পূর্ব থেকে সংঘবদ্ধভাবে বড় কোন সংগঠন ছিলো না। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠনটি ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয়। যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে প্রতিবাদী জনতার স্রোতে শাহবাগ যখন উত্তাল, তখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে দেশবিরোধীরা নানা চক্রান্ত শুরু করে। দেশের বিভিন্ন টিভি মিডিয়া, দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ এবং শাহবাগে হওয়া গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালানো হয়। বলা হয়- শাহবাগে নাস্তিক এবং ধর্মবিরোধীরা ইসলাম, আল্লাহ, নবীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। শাহবাগে আন্দোলনে আসা ব্লগাররা ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালিয়ে নবীর বিরুদ্ধে নানা কথা লিখেছে। শুধুমাত্র ইসলামী নেতাদের হত্যা করে দেশ থেকে ইসলামকে মুছে দিতেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে বলেও প্রচার চালানো হয়। দেশের বাহিরে বিভিন্ন মহলে মোটা অংকের টাকা দিয়ে আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করা হয় যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে। দেশবিরোধীদের সকল অপচেষ্টা যখন ব্যর্থ হতে থাকলো ঠিক তখনই ২০১৩ সালের ৫ মে উত্থান হলো ‘হেফাজতে ইসলাম’। ইমলাম রক্ষার নামে তাদের ভাষায় কথিত নস্তিক ব্লগারদের ফাঁসিসহ ১৩ দফা দাবিতে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে সমাবেশ করতে আসে এই সংগঠনটি। সমাবেশ থেকে বক্তারা তাদের বক্তৃতায় নানা উস্কানি দিতে থাকে। দিনভর পুলিশ এবং সাংবাদিকদের ওপর আক্রমন চালায় হেফাজতের কর্মীরা। এমনকি যেই টিভি চ্যানেল হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের খবর গুরুত্বের সাথে প্রচার করেছে, সেই চ্যানেলের নারী সাংবাদিকের ওপরেও আক্রমন চালায় তারা। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় কোরআন শরীফের দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সমাবেশ থেকে উস্কানি পেয়ে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের ওপর দু’দফা আক্রমন চালাতে এসে জনতার হাতে ধাওয়া খায় হেফাজত কর্মীরা। এমনকি রাস্তার পাশের গাছও রক্ষা পায়নি হেফাজতের ভয়ংকর ছোবল থেকে।
এদিন বিকেলের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও হঠাৎ করে মতিঝিলে টানা অবস্থানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এছাড়া সমাবেশে বিকেলে আহমদ শফী বক্তব্য রাথার কথা থাকলেও তিনি মঞ্চের ধারে কাছেও আসেন নি। সবার সামনে তখন স্পষ্ট হয়ে যায় কি তাদের আসল উদ্দেশ্য। হেফাজতের সাথে আসা অনেকেই তখন বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে মতিঝিল ত্যাগ করতে থাকেন। ধর্মভীরু এই গোষ্ঠিকে কাজে লাগিয়ে সরকার পতন করার যে চক্রান্ত যুদ্ধাপরাধীরা করে তা আর গোপন থাকেনি।
‘হেফাজতে ইসলাম’ যেহেতু সংঘবদ্ধ কোন সংগঠন ছিলোনা তাই তাদের একার পক্ষে বড় একটি সমাবেশ বা সরকার পতন করার মতো লোকবলও ছিলোনা। তাই তাদের ব্যানারে সমাবেশে আসে মূলত জামায়াত-শিবির-বিএনপিসহ বিভিন্ন ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এর বাহিরেও বিভিন্ন এতিমখানা-মাদ্রাসা থেকে কম বয়েসি শিক্ষার্থীদের ওয়াজের কথা বলে, লোভ এবং ভয় দেখিয়ে মতিঝিল সমাবেশে নিয়ে আসে হেফাজতে ইসলাম।
টানা অবস্থানের ঘোষণা থাকলেও রাত গভীর না হতেই মতিঝিলে অবস্থানকারীদের সংখ্যা নেমে আসে নগণ্যতে। পুলিশ বারবার সবাইকে মতিঝিল ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের সরাতে গেলে আক্রমণ চালায় হেফাজতের কর্মীরা। মুহূর্তের জন্য উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মতিঝিলের পরিস্থিতি। আক্রমণ চালিয়েও রক্ষা পেলোনা তারা। কানে ধরে মাথা নত করে মাটিতে বসে পড়তে হয় কাফনের কাপড় মাথায় নিয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়ার শপথ করে আসা এসব হেফাজতকারীদের। অবশেষে মতিঝিল মুক্ত হয় এই উগ্র গোষ্ঠির দখল থেকে।
এবার শুরু হয় তাদের নতুন মিথ্যা প্রচারণা। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সংঘাত কিংবা দুর্যোগের ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে এবং পত্রিকা, লিফলেটে ছাপিয়ে বলা হয় মতিঝিলে সরকার গণহত্যা চালিয়েছে। সেখানে হাজার হাজার হেফাজত কর্মীকে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও তখন সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তোলে। কিন্তু সারাদেশ থেকে এই হাজার হাজার নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মতিঝিলে স্বজন হারানোর কোন অভিযোগ করতে দেখা যায়নি। অল্প কিছু দিন পরেই হেফাজতে ইসলাম, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়া, হাজার হাজার লাশ থেকে সরে এসে শতশত লাশে নেমে আসে। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগের দিন ২৭ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মতিঝিলে হাজার হাজার হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলে নিয়ে বললেন- সরকার মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হামলা চালিয়ে শতশত মানুষকে আহত করেছে। পরীক্ষা দিতে এসে মতিঝিলে খুন হওয়া অনেক শিক্ষার্থী এখন আটক হচ্ছে। অনেক নাম বদলিয়ে স্থান পরিবর্তন করেও রক্ষা পাচ্ছে না। মতিঝিল তাণ্ডবের মাস খানেক পরে অনুষ্ঠিত দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। বলা হয় আওয়ামী লীগ নাস্তিকদের রক্ষাকারী এবং ইসলামের শত্রু।
হেফাজতের সমাবেশ থেকে যে দাবিগুলো দেওয়া হয়েছিলো তা দেশের সংবিধান পরিপন্থী, নারী অধিকারের বিরুদ্ধে, মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাদের বেশিরভাগ অভিযোগগুলোই ছিলো ভিত্তিহীন এবং মনগড়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই ছিলো হেফাজতের প্রথম দাবি। এছাড়া নারীদের শিক্ষা, নারীদের কর্মসংস্থান, বিজ্ঞান শিক্ষা বন্ধ করার দাবি তোলে তারা। মুসলমানদের ধর্ম পালনে বাধা প্রদানের মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অভিযোগও তোলে এই হেফাজতে ইসলাম।
নারীদের ‘তেঁতুল’ বলে আখ্যা দিয়ে হাসাহাসির পাত্রে পরিণত হয় হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী। একটি ওয়াজে শফী বলেন- ‘নারী হচ্ছে তেঁতুলের মতো, নারীদের দেখলে দিলের মধ্যে লালা ঝরে। গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়েরা পতিতাবৃত্তি করে টাকা উপার্জন করে। নারীদের ৫ম শ্রেণির বেশি পড়ানো উচিৎ নয়।’ আহমদ শফীর এই বক্তব্যের পরে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তখন থেকে আহমদ শফীকে ‘তেঁতুল শফী’ এবং ‘লালা শফী’ বলে অবহিত করা হয়।
চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজারে হেফাজতে নেতা ইজহারুল ইসলাম পরিচালিত জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনার পর ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে মাদ্রাসার ওই কক্ষের ধ্বংস্তূপ থেকে অবিস্ফোরিত তিনটি হাতবোমা এবং বোমা তৈরির উপাদান লোহার পাইপ ও মার্বেল উদ্ধার করে। এরপর মাদ্রাসা চত্বরে অবস্থিত মুফতি ইজাহারের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ১৮ বোতল অ্যাসিড জাতীয় পদার্থ। বিস্ফোরণে হতাহতের মতো ঘটনা ঘটলেও এটা নিছক দুর্ঘটনা বলে দাবি করে হেফাজতে ইসলাম।
আহমদ শফী তার বিভিন্ন ওয়াজে নাস্তিক ব্লগারদের হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করে আসছে। সম্প্রতি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় একটি ওয়াজে শফী বলেন- ‘আমরা তোমাদের প্রধানমন্ত্রীকে গালি দিই নাই, শুধু শুধু আমাদের দিকে চোখ বড় করে তাকাও কেন? নাস্তিকরা তোমরা মুরতাদ হয়ে গেছ, তোমাদের কতল (হত্যা) করা আমাদের ওপর ওয়াজিব হয়ে গেছে।’ বিভিন্ন ব্লগারদের হত্যার পর প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশে, এমনকি টকশো-নিউজে আহমদ শফীকে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে চিহ্নিত করে বিচারের দাবি ওঠে আসে। সর্বশেষ ব্লগার ওয়াসিকুর বাবুকে হত্যা করার সময় আটক হওয়া দুই হত্যাকারীও আহমদ শফীর মাদ্রাসারই ছাত্র।
সময় গড়িয়েছে, বদলেছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শুধু বন্ধ হয়নি ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ হত্যা। সেই হেফাজত আর বর্তমান আওয়ামী লীগের শত্রু নয়। আল্লামা শফী ওয়াজে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম কাউকে গদিতে বসাতে-নামাতে আন্দোলনে নামে নাই। আমরা আন্দোলন করছি ১৩ দফা মানার জন্য। সরকার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নাই। তারা মুসলমান হলে আমাদের ১৩ দফা মেনে নেবে। ১৩ দফা মানলে ভালো, না মানলে নাই।’
sahos24.com | Online bangla news portal
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।