সরদার ফজলুল করিম
দীপংকর গৌতম
প্রিন্টঅঅ-অ+
সরদার ফজলুল করিম ছিলেন বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন। অত্যন্ত বর্নাঢ্যময় জীবনের অধিকারী ১৯২৫ সালের ১ মে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার আটিপাড়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা খবিরউদ্দিন সরদার কৃষিকাজ করতেন। মা সফুরা বেগম ছিলেন গৃহিণী । তাঁরা দুই ভাই তিন বোন।
সরদার ফজলুল করিমের শৈশবকাল কেটেছে গ্রামে। এ কথা বলতে তার কখনো দ্বিধা করতো না। তার বাবা কৃষক ছিলো একথা তিনি গর্বের সঙ্গে বলতেন। জ্ঞান এই পিপাসু এই শিক্ষাবিদের অধ্যায়ই বৈচিত্র্যে ভরপুর। তাঁর যখন যা মনে হয়েছে সেভাবেই তিনি চলেছেন। ভেতরের লালিত আদর্শকে তিনি কখনো বিসর্জন দেননি, বরং প্রতিনিয়ত তাকে আরো দৃঢ় করেছেন।
তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, মার্কসবাদী আদর্শে লালিত ছিলেন। তাঁর জীবনে তার ছাপ ছিল। খুবই সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। বৈপ্লবিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে চাকরি ছেড়েছেন। দীর্ঘ চার দফায় মোট ১১ বছর জেল খেটেছেন। তাতে তাঁর কোনো আক্ষেপ বা অপ্রাপ্তিবোধ ছিল না। তিনি শ্যামলীতে একসময় থাকতেন, তারপর রাজাবাজার। সবখানেই গিয়েছি।
স্যারকে যখনই প্রশ্ন করতাম, স্যার কেমন আছেন? স্যার উত্তর দিতেন, কেমন-এর ‘ম’টা বাদ দাও। এখন বল কেন আছেন? এই দেশে এখন আর থাকতে চাই না। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হতো। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কমিউনিস্ট পার্টি’র কথায় আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে ছিলেন কেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, সেটা আমার ইচ্ছা। কেন দিয়েছিলাম আজ আর মনে নেই। তবে আমি মনে করি প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের বিপ্লব। আমি সেটা বিশ্বাস করি।সেজন্যই হয়তো ইহজাগতিক কোনো লোভ আমাকে পেয়ে বসেনি।
তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে অনুবাদের কাজ করেন, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একদল জওয়ান এসে খোঁজ করলো সরদার ফজলুল করিম কে? তিনি একটুও ভয় পাননি, পালিয়েও যাননি। তারা স্যারকে জিজ্ঞেস করলো, সরদার ফজলুল করিম কাহা? সরদার স্যার উত্তর তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়েই উত্তর দিলেন, ম্যায় সরদার ফজলুল করিম হুঁ। জওয়ানরা সবাই হেসে ফেললো। অত ছোট-খাট মানুষটি দেখে তাদের পছন্দ হলো না। তারা মনে করেছিল, সরদার মানে যুদ্ধংদেহি তাগড়া কোনো মানুষ, যিনি ভয়ংকর। তারা বললো, তুম সারদার নেহি, ইয়ে সারদার হ্যায়(সুঠাম দেহি একজন মানুষের আকৃতি দেখিয়ে বলছিল)। সরদার স্যার সেবার ছাড়া পেলেন। মগবাজারের বাসায় তিনি থাকতেন না। কিন্তু বাজার করে দিয়ে আসতেন ছেলে, ছেলের বউ, নাতিদের জন্য। কর্তব্যবোধে তাঁর কোনো বিচ্যুতি ছিল না। একবারের একটি ঘটনা আজ খুব মনে পড়ছে। স্যার তখন শ্যামলীর বাসায় থাকেন। আমার সাথে স্যারের কথা ছিল, আমি তাঁকে মগবাজার নিয়ে যাবো। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার যখন পৌছার কথা, স্যার তখন যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছেন। আমি তখন কমিউনিস্ট পার্টির মতিঝিল থানা কমিটির সভাপতি। ওই দিন সকালেই আমার একটা মিটিং ছিল। আমি মিটিং শেষ করে স্যারের বাসায় পৌঁছাতে পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেল। স্যার বললেন, তুমি পাঁচ মিনিটি দেরি করেছো। কেন দেরি করলে? তোমার তো পাঁচ মিনিট দেরি করে আসার কথা ছিল না। আমি বললাম, স্যার আজ আমার পার্টির মিটিংয়ের জন্য দেরি হয়েগেছে।
স্যার বললেন, তুমি কোন পার্টি কর? আমি বললাম, কমিউনিস্ট পার্টি। স্যার বললেন, তুমি তো নিজেই কমিউনিস্ট হতে পারোনি, তো পার্টি করবে কীভাবে? পারলে নিজে কমিউনিস্ট হও। তারপর পার্টিটা করো। নতুবা পার্টির সর্বনাশ হবে, তোমাদের মতো এসব নেতা-কর্মীদের কারণে।স্যার আজ নিরন্তরের পথিক। আজ আর একথা কেউ বলবে না। শাহবাগের বাবুল ইলেকট্রনিক্সের আড্ডায় স্যারের সঙ্গে আর দেখা হবে না। পূর্ণ দা’র বয়স বেড়েছে। স্যার তাঁকে আর কোনো দিন খবর পাঠাবেন না। এই শূন্যতা নিয়ে আমার ঢাকা শহরে দিন কাটাবো। মাঝখান থেকে সরদার স্যারের মতো গুণীরা চলে যাবেন, দেশটা ক্রমশ নষ্টদের দখলে চলে যাবে। স্যারের এমন মৃত্যু কখনো কল্পনা করিনি। বয়স ৮৯ হলেও স্যারের যে পরিমান আত্মবিশ্বাস ছিল তার কোনো তুলনা হয় না।
একবার পিজি হাসপাতালের সামনে স্কুটার দুর্ঘটনায় তাঁর পা ভেঙে গেলে সবাই যখন তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে ব্যস্ত, কেউ কেউ স্কুটার ড্রাইভারকে খুঁজছে, স্যার তখন বললেন, স্কুটার ড্রাইভারকে কেউ কিছু বলো না। কারণ ওর গাড়িতে না উঠলে এই দুর্ঘটনা হয়তো হতো না। কেউ জানতো না আমাকে কত মানুষ ভালোবাসে। হাসপাতাল ছেয়ে গেছে তরুণ-যুবায়। এতো মানুষ যে আমাকে ভালোবাসে তা ওই স্কুটার ড্রাইভার আমাকে জানিয়ে দিয়ে গেল। ভাঙা পা সেরে ওঠার একপর্যায়ে স্যারকে নিয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম। স্যারের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি স্যারের হাত ধরে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম।
স্যার বললেন, তুমি আমাকে ধরতে চেষ্টা করছো কেন? আমি তো জানি আমাকে সাহায্য করার জন্য তুমি আছো। আমার সমস্যা হলে তো আমিই তোমাকে বলবো। কেউ কখনো সাহায্য না চাইলে তাকে সাহায্য করতে নেই। সেটা আমিও কারবো না, তুমিও করবে না। স্যারের এই দৃঢ়চেতা মানসিকতা আমাদের পাথেয়। স্যারের নিজেকে দিন দিন আপডেট করার কথা সবাইকে বলতেন। গুরুত্বহীন কোনো কথা স্যারকে কখনো বলতে শুনিনি। স্যারের মৃত্যুর অপূরণীয় ক্ষতি, কখনো শেষ হবে না।
সরদার স্যার ম্যাট্রিকুলেশন শেষে প্রথম ঢাকা আসেন ১৯৪০ সালে। ঢাকায় ১৯৪২ সনে তিনি তার আই.এ. পাঠ সমাপ্ত করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৪৫ সনে দর্শনশাস্ত্রে অনার্স ও ১৯৪৬ সনে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
পরবর্তীতে তার সাম্যবাদী বামপন্থী সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকার পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিগৃহীত হন। রাজবন্দি হিসেবে দীর্ঘ ১১ বৎসর বিভিন্ন পর্যায়ে কারাজীবন যাপন করেন। জেলে থাকা অবস্থাতেই ১৯৫৪ সনে তিনি পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য হিসেবে কাজ করেন। পরে ১৯৬৩ থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পাকিস্তান হানাদারবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হন। পরবর্তিতে তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদান শুরু করেন।
সাহিত্য
চল্লিশের দশকে ঢাকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
রুমীর আম্মা
নানা কথা
নানা কথার পরের কথা
নূহের কিশতী ও অন্যান্য প্রবন্ধ
গল্পের গল্প
অনুবাদ
প্লেটোর রিপাবলিক
প্লেটোর সংলাপ
এরিস্টোটল-এর পলিটিক্স
এঙ্গেলস্-এর এ্যান্টি ডুরিং
রুশোর- সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট
রুশোর- দি কনফেশনস
পাঠ-প্রসঙ্গ
অন্যান্য রচনা
দর্শনকোষ
শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা স্মারকগ্রন্থ
সেই সে কাল : কিছু স্মৃতি কিছু কথা
তিনি কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ যেসব পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন -সিধু ভাই স্মৃতিপদক ১৯৯৮; দৈনিক জনকন্ঠ গুণীজন সম্মাননা ১৯৯৯; বরিশাল বিভাগ সমিতি, ঢাকা কর্তৃক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ‘শেরে বাংলা পদক’ (২০০০); ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ কর্তৃক গুণীজন সম্মাননা ২০০১; স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ২০০০; ‘দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক’ ২০০৫; সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার ২০০৮, বাংলা একাডেমী পুরস্কার।
এই মহান কর্মবীর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শমরিতা হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে(আইসিইউ) থাকার পর ২০১৪ সালে ১৪ জুন শনিবার রাত পৌনে ১টার দিকে না-ফেরার দেশে চলে যান। তাঁর শোক জানাবার ভাষা আমাদের নেই। এই অভিভাবককে হারিয়ে আমরা নিথর নির্বাক হয়ে গেছি। স্যারের বিশাল কর্মজীবন ও স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।