লাইসেন্স বাতিল
ঝালকাঠিতে ‘ওয়ার্ল্ডমিশন ২১’ আদালতের স্থগিতাদেশ দেখিয়ে চালাচ্ছে প্রতারণা
রাজু খান, ঝালকাঠি
প্রিন্টঅঅ-অ+
সরকারের লাইসেন্স না দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের স্থগিতাদেশ দেখিয়ে প্রতারণা চালাচ্ছে কয়েকটি বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি।
লাইসেন্স না পেয়ে কোম্পানিগুলো আদালতে রিট আবেদন করেছিল। লাইসেন্স নবায়ন না হওয়ায় আদালত থেকে সর্বশেষ স্থগিতাদেশ নিয়েছে চারটি এমএলএম কোম্পানি। এগুলো হলো এমএক্সএন মডার্ন হারবাল ফুড, ওয়ার্ল্ডমিশন ২১, স্বাধীন অনলাইন পাবলিক লিমিটেড ও রিচ বিজনেস সিস্টেম। এর মধ্যে ঝালকাঠি ব্যবসার নামে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ল্ড মিশন ২১। এই চার কোম্পানি ২০১৪ সালের মার্চে এমএলএম ব্যবসা করার লাইসেন্স পায় যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো) থেকে। কিন্তু এ বছরের মার্চে রেজসকো তা আর নবায়ন না করায় তারা আদালতে যায়।
আবেদন করে লাইসেন্স না পেয়ে এর আগে আরও কয়েকটি কোম্পানি সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এগুলো হলো ফরএভার লিভিং প্রোডাক্ট, ড্রিম টুগেদার, ম্যাকনাম ইন্টারন্যাশনাল, ডেসটিনি ২০০০, টিয়ানসি বিডি, দেশান বিডি, পিনাসেল সোর্সিং ও লাইফওয়ে বিডি। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কারণ দর্শানোর নোটিস দেন এবং মন্ত্রণালয় যে চিঠিতে লাইসেন্স না দেওয়ার কথা কোম্পানিগুলোকে জানায়, আদালত ওই চিঠির কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। এই সময়সীমা শেষ হলে কয়েকটি কোম্পানি আদালত থেকে আরও তিন মাস সময় পেয়েছেন বলেও জানা গেছে।
এদিকে ডেসটিনি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঝালকাঠির ডেসটিনির অনেক কর্মকর্তারাই ওয়ার্ল্ডভিশন ২১ এর কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ১৩ এপ্রিল বিকেলে সদর থানা সংলগ্ন সানাই কমিউনিটি সেন্টারে এক বাণিজ্যিক সেমিনার করে। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন কোম্পানির সেভেন স্টার মোঃ রাকিব হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন কোম্পানির সিক্স স্টার মোঃ আনোয়ার হোসেন, ফাইভ স্টার মোঃ লোকমান হোসাইন, ফোর স্টার ও বিভাগীয় কো-অর্ডিনেটর মোঃ ওমর ফারুক। সভাপতিত্ব করেন জেলা সমন্বয়কারী ও কোম্পানির থ্রি স্টার মোঃ আনিসুর রহমান। এ বাণিজ্যিক সেমিনারে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আড়াইশত তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতী অংশ গ্রহণ করেন।
এ সময় জেলা সমন্বয়কারী বলেন, আমরা পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে সেমিনার করার জন্য অনুমতি এনেছি। আমাদের ব্যবসা হচ্ছে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের সাথে। মোবাইল, ফ্রিজ, টিভি, এসি, মিনি ল্যাপটপ, ক্যামেরা, ওভেন, ফ্যানসহ ২৮ টিরও বেশি পণ্য রয়েছে। জনসাধারণের অভিযোগ রয়েছে, অল্পমেয়াদী ও খারাপ মানের কিছু পণ্য এনে অধিক মুনাফা দেখিয়ে শিক্ষিত বেকারদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। তারা তাঁদের নিকটাত্মীয় ও স্বজনদের কাছে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের কথা অনুযায়ী লোভনীয় অফার দিয়ে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। একপর্যায়ে কোম্পানির প্রতারণা বুঝতে পারায় নিজেদের সম্পর্কের দূরত্বের সৃষ্টি হয়।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, প্রায় দেড় যুগ ধরে চললেও এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করার কোনো আইন ছিল না দেশে। অথচ রেজসকো থেকে নিবন্ধন নিয়ে শতাধিক এমএলএম কোম্পানি গড়ে ওঠে দেশে। ডেসটিনি গ্রুপের অনিয়ম-দুর্নীতি ও প্রতারণার ফাঁদ ধরা পড়ার পর সরকার বিষয়টি প্রথম আমলে নেয় ২০১২ সালে। এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসার মাধ্যমে এক যুগ ধরে (২০০০-২০১২) ডেসটিনি মানুষের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করেছে। প্রায় সব প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা পাঁচ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা। গ্রাহকের অর্থে তাঁরা নিজেদের নামে বাড়ি-গাড়ি করেছেন। শতকোটির বেশি টাকা পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে ডেসটিনির ৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর এদিকে ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণয়ন করা হয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন। এই আইনের অধীনে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা হয় বিধিমালা, যা আবার সংশোধন করা হয় ওই বছরেরই ২২ জুলাই। আইনে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আর লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা করা হয় রেজসকোকে। এ আইন অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া এমএলএম ব্যবসা করা যায় না। সরকারের অনুমোদন ছাড়া লাইসেন্স হস্তান্তর করতেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
আইনে বলা রয়েছে, পিরামিডসাদৃশ বিপণন কার্যক্রম চালানো, সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য বা সেবা বিক্রি না করা, পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং অসত্য, কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দায়িত্ব নিয়েই ২০১৪ সালের ৫ মার্চ এক বছরের জন্য চার কোম্পানিকে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করার লাইসেন্স দেয় রেজসকো। কোম্পানিগুলো হচ্ছে এমএক্সএন মডার্ন হারবাল ফুড, ওয়ার্ল্ডভিশন ২১, স্বাধীন অনলাইন পাবলিক লিমিটেড ও রিচ বিজনেস সিস্টেম। এদের লাইসেন্সের মেয়াদ এ বছরের ৪ মার্চ শেষ হয়েছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে সরকার। কোম্পানিগুলো লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করলেও রেজসকো নবায়ন করেনি। কোম্পানি চারটি শর্ত ভঙ্গ করেছে বলে জানা গেছে। রেজসকোর কর্মকর্তারা জানান, লাইসেন্স দেওয়া হয়নি, তাই কোনো কোম্পানিই এই পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা ও নতুন গ্রাহক তৈরি করতে পারবে না।
রেজসকোর কাছে অবশ্য লাইসেন্সের জন্য মোট ২১টি আবেদন জমা পড়ে। চারটিকে লাইসেন্স দেওয়া হলেও বাকি ১৭টি পায়নি। না পাওয়া কোম্পানিগুলো হচ্ছে: ডেসটিনি ২০০০ লি., এমওয়ে ইন্টারন্যাশনাল, টিয়ানসি বিডি, এসএমএন গ্লোবাল, এবি নিউট্রিক ইন্টারন্যাশনাল, অ্যাডভান্স বাংলা, দেশান বিডি, ডি ক্ল্যাসিক লাইফ বিডি, ড্রিম টুগেদার, একসিলেন্ট ফিউচার মার্কেটিং, ফরেভার লিভিং প্রডাক্টস বিডি, পিনাসেল সোর্সিং, সানুস লাইফ বিডি, লাইফওয়ে বিডি, লাক্সার গ্লোবাল এন, ম্যাকনম ইন্টারন্যাশনাল এবং ভিশন ইন্ডাস্ট্রিজ বিডি লিমিটেড। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আপিল করে তারা এবং দফায় দফায় শুনানি করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় লাইসেন্স দেয়নি একটিকেও। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানি লাইসেন্সের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। কয়েকটি কোম্পানিকে আদালত তিন মাস আবার কয়েকটিকে ছয় মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছে।
রেজসকো সূত্র জানায়, সংস্থাটি তদন্ত করে দেখেছে, এদের লাইসেন্স আর নবায়ন করা যায় না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিও এ ব্যাপারে একটি সংসদীয় সাব-কমিটি গঠন করে। এ কমিটি এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কার্যক্রম তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতেও এমএলএম লাইসেন্স না দেওয়ার সুপারিশ করা হয় বলে জানা গেছে।
এদিকে গত ডিসেম্বরে এক সরকারি তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, লাইসেন্স ছাড়া এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করা জামিন অযোগ্য অপরাধ। এতে লাইসেন্স ছাড়া কেউ এই ব্যবসা করলে ও প্রতারণা করে থাকলে কাছাকাছি থানা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করতে সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানায় সরকার। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানান, দেশের মানুষের ভুলোমনা চরিত্র, অত্যধিক লোভ প্রবণতা, দুর্নীতিপরায়ণতা ও আয়েশি মনোভাব। তাঁরা বলেন, এমএলএম বিতর্কিত পদ্ধতির ব্যবসা। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা ধরা পড়েছে। ডেসটিনির প্রতারণা ধরা পড়ার পর বরং উচিত ছিল বাংলাদেশে এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। তা না করে উল্টো একটি আইন করা হয়েছে, যার আদৌ কোনো দরকার ছিল না। আইনটি প্রণয়নের সময় এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল। অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে নব্বইয়ের দশকে আওয়ামীলীগের প্রয়াত নেতা মোস্তাফিজুর রহমান গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই)। এটি পরে বিলুপ্ত করা হয়
যুব কর্মসংস্থান সোসাইটিতে (যুবক) গ্রাহকের কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকা পড়েছে, সরকার ১০ বছরেও যার সুরাহা করতে পারেনি। এর পরই এসেছে ডেসটিনি। দুঃখজনক যে, এত কিছু দেখার পরও এ জাতীয় কোম্পানির ফাঁদেই বারবার ধরা পড়ছে সাধারণ মানুষ।
এ বিষয়ে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে বাণিজ্যসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘দেশে এই মুহূর্তে লাইসেন্স পাওয়া কোনো এমএলএম কোম্পানি নেই। কেউ যদি লাইসেন্স ছাড়াই এই পদ্ধতিতে ব্যবসা করেন, আইনানুযায়ী দন্ডনীয় হবেন। আর লাইসেন্স নেই জেনেও কোনো মানুষ যদি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করেন, এর দায়দায়িত্বও তাঁদেরই। সাধারণ মানুষ এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লে নিশ্চিতভাবেই তাঁরা ঠকবেন এবং কোনো প্রতিকারও পাবেন না।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।