এই মুহূর্তের কর্তব্য পালনে লেনিনই আমাদের পথপ্রদর্শক
২০১৫ সালের ২২শে এপ্রিল কমরেড লেনিনের ১৪৬তম জন্মদিবস। বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বুকে সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা নভেম্বর বিপ্লব যার মধ্য দিয়ে রুশ দেশে সর্বহারার রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠলো, তার প্রধান নেতা ও সংগঠক ছিলেন কমরেড লেনিন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদ অর্থাৎ মার্কসবাদকে সমৃদ্ধতর করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। বিশ্বের দেশে দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টি হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রামে তিনি ছিলেন অবিসংবাদী নেতা। প্রতিবারের মতো এবছরও ভারতসহ বিশ্বের দেশে দেশে শোষিত ও মেহনতি মানুষ কমরেড লেনিনকে স্মরণ করে, তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে পুঁজিবাদী শোষণের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে সংগ্রাম-আন্দোলনকে তীব্রতর করতে এই দিনটিকে নতুন করে শপথ গ্রহণের দিন হিসাবে ব্যবহার করবেন।
অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন মার্কসবাদী
কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ঊনবিংশ শতাব্দীতে মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন। দুনিয়ার বুক থেকে সমস্ত ধরনের শোষণের অবসান ঘটানোর লক্ষ্য নিয়েই গড়ে উঠলো এই মতবাদ। লেনিন মার্কসীয় মতবাদকে আত্মস্থ করলেন। ‘‘দার্শনিকরা এতকাল ধরে দুনিয়াটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু মূল কথা হলো একে পরিবর্তন করা।’’ কার্ল মার্কসের এই মহান উক্তি তিনি প্রকৃত অর্থেই আত্মস্থ করেছিলেন। শোষণের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলতে হলে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হবে। জারশাসিত রুশ দেশে এ কাজ করা খুব সহজ ছিল না। শ্রমিক-কৃষকসহ মেহনতি মানুষের মধ্যে মার্কসবাদ প্রসারিত করতে তিনি ছিলেন প্রধান উদ্যোগী। তত্ত্ব ও কর্মের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে একজন প্রকৃত মার্কসবাদী গড়ে ওঠে — কমরেড লেনিনের জীবন তার সেরা উদাহরণ।
বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনা করার সাথে সাথে মার্কসবাদকে সমৃদ্ধতর করার কাজে তিনি মনোনিবেশ করেন। পুঁজিবাদের বিকাশের ধারাতেই সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকটকে তীব্রতর করে, সর্বহারা বিপ্লবের সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এই কথাগুলি উপস্থিত করলেন কমরেড লেনিন। সমৃদ্ধ হলো, বিকশিত হলো মার্কসীয় অর্থনীতি। বিশ্বায়নের নামে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র ও কার্যধারা উপলব্ধির সেরা হাতিয়ার হলো সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে লেনিনের বিশ্লেষণ।
লেনিনের সমসাময়িককালে মার্কসবাদী মতাদর্শের মর্মবস্তু দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্বকে তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। বিজ্ঞানের অগ্রগতির অপব্যাখ্যাই ছিল আক্রমণকারীদের মূল হাতিয়ার। দ্বান্দ্বিকতার দর্শনকে রক্ষা ও বিকশিত করার সংগ্রামে লেনিন ছিলেন সেনাধ্যক্ষ। এরই সাথে সাথে বিপ্লবের বিজ্ঞানকে গড়ে তোলা ও বিকাশ ঘটানোর প্রক্রিয়ায় তিনি প্রকৃত নেতার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সর্বহারার বিপ্লব সফল হতে পারে না অগ্রণী বাহিনী (Vanguard) ব্যতিরেকে। কমিউনিস্ট পার্টি হলো সেই অগ্রণী বাহিনী। এই অগ্রণী বাহিনী যে মূলনীতিগুলির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, সেইগুলি সূত্রায়িত করার ক্ষেত্রে লেনিনের অবদান অনস্বীকার্য।
নভেম্বর বিপ্লবের তাত্ত্বিক নেতা ও সংগঠক যেমন ছিলেন কমরেড লেনিন, আবার রুশ দেশে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার প্রক্রিয়ারও নেতা ছিলেন তিনি। প্রকৃত মার্কসবাদী বলতে কি বোঝায় তার প্রতিমূর্তি ছিলেন লেনিন।
লেনিন আমাদের শিক্ষক
যে-কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও শোষণবিরোধী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর থাকতে হয় মার্কসবাদীদের। নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এ কাজ করতে হবে। এটাই হলো কমরেড লেনিনের শিক্ষা। লেনিন মার্কসবাদের মর্মবস্তু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণই হলো মার্কসবাদের মর্মবস্তু’।
লেনিনের এই মহান শিক্ষাকে অবলম্বন করেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র ২১তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতির মূল্যায়নের সাথে সাথে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার লক্ষ্যে এই মুহূর্তের অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা হয়েছে। বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করার মধ্য দিয়ে শ্রেণিশক্তির ভারসাম্যের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে কাজকেই এই মুহূর্তের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিগত প্রায় ২৫ বছর ধরে পার্টি যে রাজনৈতিক-রণকৌশলগত লাইন অনুসরণ করেছে তার পর্যালোচনা করা হয়েছে ২১তম কংগ্রেসে। সমগ্র দেশজুড়ে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও প্রসারিত করার কাজ কোনো কোনো সময়ে দুর্বল হয়েছে। নির্বাচনী সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে গিয়ে বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের বিষয়টিকে পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে পার্টি আত্মসমালোচনা করেছে।
বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করার সাথে সাথে চারটি প্রধান সমাজিক দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে পরিস্থিতির মধ্যে দ্বন্দ্বগুলিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আন্তর্জাতিক সংহতির গুরুত্ব ও তা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সি পি আই (এম)-র ভূমিকার দিকনির্দেশ করা হয়েছে।
ভারতের জাতীয় পরিস্থিতিতে বৃহৎ পুঁজিপতিদের নেতৃত্বে ভারত রাষ্ট্র যে নয়া উদারনীতির পথ গ্রহণ করেছে তার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে যে শ্রমিক-কৃষকসহ সাধারণ জনগণ ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত তথ্যসহ তা তুলে ধরা হয়েছে। সাথে সাথে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বি জে পি-র সরকার কেন্দ্রে আসীন হওয়ার পর বিগত প্রায় ১১ মাসে জনবিরোধী নয়া উদারনীতি আরোপের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদীদের লুটের জন্য আমাদের দেশকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আক্রান্ত মানুষের সংগ্রামকে বৃদ্ধি করা ও সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়টিকে সি পি আই (এম) বিশেষভাবে জোর দিয়েছে।
কেন্দ্রের সরকারে বি জে পি-র অধিষ্ঠানের ফলে ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতিতে আর এস এস-এর ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী চিন্তাধারা সরাসরি কেন্দ্রের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রসারিত হচ্ছে। সুপরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটাচ্ছে বি জে পি-আর এস এস এবং তাদের সরকার। প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম সন্ত্রাসবাদী কার্যধারার বিপদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা সংগ্রামী মানুষের ঐক্যের পথে চরম বিপদ। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে সমন্বিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির মোর্চার বিকল্প গড়ে তোলার জন্য সি পি আই (এম)-র স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটানোর বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামী দিনে সমগ্র দেশজুড়ে পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে যা যা করণীয় তার আলোচনা করা হয়েছে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে পার্টি সংগঠনকে জোরদার করার প্রশ্নে প্লেনাম সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
কমরেড লেনিন আমাদের পথপ্রদর্শক
সমগ্র দেশজুড়ে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করতে হবে সি পি আই (এম)-কে। বুর্জোয়া-জমিদার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মেহনতি ও গণতান্ত্রিক মানুষের জোট হিসাবেই বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির বিকল্প গড়ে তুলতে হবে। লক্ষ্যে অবিচল থেকেই সঠিক রণকৌশল অবলম্বন করতে হবে। এটাই তো কমরেড লেনিনের শিক্ষা। রণকৌশলকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা ও লক্ষ্যপথে এগিয়ে চলা সমস্ত কিছুই নির্ভর করবে শক্তিশালী সি পি আই (এম)-র ওপর। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতাদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির দ্বারা পরিচালিত যে পার্টির শ্রমিক-কৃষকসহ জনগণের বিভিন্ন অংশের সাথে জীবন্ত ও নিবিড় সম্পর্ক থাকবে এমনভাবে গড়ে তুলেই সি পি আই (এম)-র শক্তির বৃদ্ধি ঘটতে পারে। পার্টি সংগঠন সম্পর্কে লেনিনের শিক্ষাকে আত্মস্থ করেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতাদর্শের ভিত্তিতে চিরতরে শোষণের অবসান ঘটিয়ে ভারতীয় সমাজকে পুনর্গঠিত করতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র যে সংগ্রাম তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কমরেড লেনিনই আমাদের পথপ্রদর্শক।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।