আপনারা তো জাউড়া!
মুন্নী সাহা
প্রিন্টঅঅ-অ+
ঢাকার মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠান, “মিট ঢাকা" এর রেকর্ডিং এর জন্য তড়িঘড়ি করে নামছিলাম অফিস থেকে। সন্ধ্যা ৬টার নিউজ শুরু হয়েছে কেবল। লিড- কারওয়ান বাজারে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলা। সহকর্মী আমিনুল, লাইভে। ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে ‘এ্যা’ ‘ও’ করে কি যেন বলছিলো। আমি রাগারাগি করি- কী বলছে এসব, কথার ধার নাই- কিচ্ছু নাই! থামাও... ফুটেজ দেখাও। দশ মিনিট ধরে ওর এ্যা.. ও.. কেন রে বাবা?
আমার কথা পছন্দ হলো না কয়েকজন ফেয়ার সহকর্মীর। এটিএন নিউজে গণতন্ত্র চলে, ফলে তর্ক এলাউড। সুশীল বার্তা সম্পাদকদের একজন অমানবিকতার ছবি বর্ণনা করলেন, খালেদা জিয়ার বহরে ছাত্রলীগিয় হামলার। আমি কনভিন্সড... খালেদা জিয়া ভোট চাইতে বেড়িয়েছেন, মানবিক কারণে আদর্শ ঢাকার হবু নগর পিতার জন্য। যাকে তিনি সমর্থন দিয়েছেন। আর সেখানে, কারওয়ান বাজারের মত মিডিয়া ঘন একটি এলাকায় সরকার দলের সমর্থক ছাত্র সংগঠন যে অমানবিক দৃশ্যটি রচনা করলো, তা আমাদের অনেকের জন্যই মানবিক হয়ে উঠলো, মানবিক সাংবাদিকতায় আমরা এর আদ্যপান্ত খুঁজে, অপরাধীদের ধিক্কার দেই, ঘৃনা ছড়াই তাদের রাজনীতি নিয়ে। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন এরচেয়ে ফলপ্রসু হতে পারে আর কিভাবে? আমরা বিস্মৃতিপরায়ন জাতি না! শীতকালের কথা গ্রীষ্মকালেই ভুলে যাই, ছয় ঋতুর পরিবর্তনের মত, যেমনটা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এই কারওয়ান বাজারে আমরা মিডিয়ার্কমীরা চাতকের মত কত অপেক্ষা করছি, একটু মানবিক দৃশ্য ধারণ করার জন্য ... ইস্ একবার যদি ম্যাডাম বার্ন ইউনিটে যাওয়ার জন্য রওনা হতেন, আর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কাভারেজ আরো মানবিক করার জন্য তাঁকে তাড়া করতো, ইট মারতো গাড়ীতে, আমরা লাইভ করতাম, দেশী বিদেশী মানবিক রির্পোট ... আর যায় কই! তিরানব্বই দিন, (যে কদিন উনি র্কাযালয়ে ছিলেন) অপেক্ষা করে দেশের মানুষের জন্য মানবিক এই নেতার মানবিক ছবিটি পাইনি। বেটার লেট দেন নেভার। র্নিবাচনের কারনে অন্ত:ত তিনি কষ্ট করে ভোট চাইছেন, আমাদের জন্য কিছু মানবিক ফুটেজ উপহার দিচ্ছেন, আমরা কৃতজ্ঞ! কৃতজ্ঞ ছাত্রলীগ বা নামধারী সংগঠনের প্রতি, তারা থাকলে , যে কোন সাধারন ছবিও সরকারের বিরুদ্ধে সহজেই মানবিক করে তোলা যায়। আমাদের কাটতি বাড়ে, সুশীলের পাল্লাভারী হয়। অনলাইন- অফলাইনে আমরা প্রতিযোগিতায় নামি।
সহকর্মী বন্ধুটি আমার সাংবাদিকতার স্পিরিটটি বোঝেননি, খালি পর্দায় এক রিপোর্টারের ভুল উচ্চারনে গ্যা গ্যা আমি আপাতত থামাতে বলেছি মাত্র, খালেদা জিয়ার মানবিক ছবি নয় ।
এসব নিয়ে আর সময়নষ্ট না করে চলে যাই, কৃষিবিদ ইন্সটিউশন মিলনায়তনে, আমাদের “মিট ঢাকা” অনুষ্ঠান রেকর্ডিং এ। শুরুতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এই হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। বাস মার্কায় ভোট চাইতে যাওয়া খালেদা জিয়ার ওপর এ হামলা মানবিক ঢাকার পরিপন্থী। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে যানজট নিরসনে “বাস” প্রতীকের অধিকারী তাবিথ, বাসের লেন, চলাচলে শৃঙ্খলা ইত্যাদির কথা বলছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমার পাল্টা প্রশ্ন ---‘এই লেনে বাস, পেট্রোল বোমায় পুড়বে না তো’? স্মার্ট তাবিথ কিছুটা ডিফেন্ড ক’রে, কিছুটা অস্বীকার ক’রে আমাকে সামলালেন। ঘাঘু কেউ হলে হয়তো, খালেদা জিয়াকে দেখিয়ে দিতেন। তাবিথ, ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ আচরণ করেননি অন্যদের মতো। কয়দিন আগেই বাসে পেট্রোল বোমার জন্য অভিযুক্ত তার দল, তা মেনে নিয়েই রাজনীতির খেলায় আছেন, ‘মানবিক’ ‘অমানবিক’ প্রশ্ন সব জেনে বুঝেই। ভোটাররাই ঠিক করবেন, কী মানবিক, কোনটা অমানবিক। অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতে প্রশ্ন নিয়ে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হলাম প্রিয় এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে। উনি বলছিলেন, পেট্রোল বোমা, পোড়া বাস, এসব নিয়ে তাবিথকে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি--- এটা আপনার অমানবিক আচরন। হুম! মেনে নিলাম, মাথা নেড়ে। এ প্রসঙ্গে আমার যুক্তি --- “আমি নিজেকে অনেক বেশি যে শ্রেনির প্রতিনিধি মনে করি, মানে সাধারন মধ্যবিত্ত, তাদের স্মৃতি অতটা ঝাপসা নয়। ন্যায়-অন্যায়টা নিজেদের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি দিয়ে তারা বিচার করে না। তাদের কাছে, আমি অমানবিক হতাম, যদি তাবিথকে প্রশ্নই না করতাম--- ‘বাস মার্কা, পেট্রোল বোমায় পোড়া বাস না তো’?” বন্ধুটি খুশি হননি, কিন্তু আমি যেমন, আমাকে তেমনটি মেনে নিয়ে মাথা নাড়ান।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে গাড়িতে টিভি, অনলাইন এ খবরগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। দেখলাম কত কষ্ট করে বিএনপি চেয়ারপারসন গাড়ির দরজা ধরে ঝুলে আছেন, (ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন)। ভয়াবহ অমানবিক!
‘মানবিক ঢাকার ব্র্যান্ড’এর দাবিদার, ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী আনিসুল হকও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন, যদিও তার মানবিক ঢাকা মানে, শুধুমাত্র গরীব, বস্তিবাসীর শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের সংস্থান... যেটা তিনি বারবারই ‘মানবিক ঢাকা’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন। এখানে মানবিক রাজনীতির কোনো স্থান নেই। ফেসবুক এ নানান জনের নানান কমেন্ট, হবু মেয়রদের কনসার্ন, মানবিকতা, রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব নিয়ে স্ট্যাটাস পাঠের সময় আমি জ্যামে, বিজয় সরনীর মোড়। হঠাৎ জানালায় টোকা... আপা কাঁচটা নামান.. নামান...। মহিলার (আমার বয়েসী হবে, তাই মহিলা বলছি) হাতে বেলি ফুলের মালা। এত্ত সুন্দর, আপন, মায়াবি, মানবিক হাসি... আমার কাছে প্রিয় বেলি ফুলের চেয়েও সুন্দর লাগলো রাস্তার নিওন আলোয়। মালার গোনা বাছা নাই, বাম হাতে ঝুলিয়ে রাখা মালা খুলতে খুলতে বলছিলো---- আল্লাগো, প্রতিদিন এই মানুষডারে টিভিতে দেহি আর কই, কবে রাস্তায় দেহুম একনজর (পাঠক, ক্ষমা করবেন-- নিজের ঢাক পেটানো হচ্ছে মনে হতে পারে। কিন্তু আমি নিজেকে ব্লেসড মনে করি যে টিভির কল্যাণে আমি উচ্চ শ্রেনির মানুষদের কাছে তর্কিত বিতর্কিত যা--ই হই না কেন, সাধারন খেটে খাওয়া সহজ মানুষেরা আমাকে দেখে এই একই ধরনের আচরণ করেন। আমি কৃতজ্ঞ)
আমি হাসতে হাসতে মহিলাকে বলি, দোয়া করবেন। আমার গাড়ির সিটে প্রায় সব প্রার্থীর মেনিফেস্টো, পোস্টার, আনিস ভাইয়ের মানবিক ঢাকার চিঠি। এসব দেখে, আমার বেলীওয়ালী জিজ্ঞেস করেন... আপা ভোটের চিঠি দেন? বললাম-- নাহ। যারা ভোট করে, তাগো সাক্ষাতকার নিলাম, বুঝলা? কী কয় হেরা আপা? এই হরতাল, পোড়াপুড়ি বন্ধ করবো নি? আমি হাসি! এই প্রশ্ন কি আমি করতে পেরেছি! নাখালপাড়ার বাসিন্দা আমার এই ফুলওয়ালী। ইতোমধ্যে তার এলাকায় যে সব মার্কার লিফলেট পেয়েছে, সব মুখস্ত বলছে। যেন সাংবাদিককে পেয়ে সোর্স এর তথ্য সমর্পন চলছে। আমি বললাম --- বুঝলাম, তো কারে ভোট দেবেন? মহিলা বললেন, আপা মার্কায় তো বিএমপি (bnp উচ্চারণটি এভাবে করেছে) আম্লেগ বুঝি না। আমি বললাম, এত আওয়ামী লীগ-বিএনপি বুইজা কি হইবো, মানুষ পছন্দ হয় কিনা দেখেন, তারে ভোট দেন ...
আমাকে একটু তাচ্ছিল্য করে বললেন--- আপনে এই কথা কন? একটা পোলাফাইন স্কুলে গেছে? আমার বাচ্চারে কষ্ট কইরা পড়াই আপা, পরীক্ষা হয় নাই, স্কুলে যায় নাই... কী অবস্থা! আর মানুষগুলান যে ফুড়ছে (পুড়েছে বলতে চেয়েছেন)?
আমি বললাম, আপনার কি? আপনার কেউ পুড়ছে? ঢাকায় আপনার এলাকায়, যে বেশী সুযোগ সুবিধা দিবো কয়, তারে ভোট দেন ---
এবার আর আমারে পছন্দ হলো না তার, হাত থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট টা টান মেরে নিয়ে বললেন... আমগো গরীবের নীতি আছে, আমার ঘরে পুড়ুক, চাই না পুড়ুক, মানুষ তো মরছে? এর বিচার হইবো না? আমি টকশোর মত প্যাচানো শুরু করলাম--- এই ভোটের সাথে কী সম্পর্ক, যে দল বাস পোড়াইছে... পোড়াইছে। ওনাদের মানুষরা যদি ভালো কথা কয়, ভালো সুবিধা দেয়.. দিলাম আমরা ঢাকার মানুষ তাগোরে জিতাইয়া। আমার এই মানবিক যুক্তির সাথে সাথে হলুদবাতি সবুজ হলো। আমার গাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ পলিটিক্যাল ভ্যাজর ভ্যাজরের পর আমাকে স্বার্থপরই মনে হলো হয়তো বেলিফুলের। এত কাঙ্খিত মুখকে এক ঝটকায় কলঙ্কিত করতেও তার হয়তো তার মানবিকতায় বাঁধছিলো, তাই মুখে পলিটিক্যাল হাসি দিয়ে সবুজ বাতির দিকে আমার লাল গাড়িটি বিদায় দিলেন, মুখে বহুবচন টেনে, আমাদের মত অনেক সো-কল্ড মানবিকদের চাপা গলায় গালি দিলেন---- ‘আপনারা তো জাউড়া, আমরা না!’
লেখক: মুন্নী সাহা, বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।