শান্তি সনদের অারেক বলি ওয়াশিকুর রহমান
মাত্র একমাস চারদিন আগে মৌলবাদী গোষ্ঠির হাতে খুন হয়েছিলেন লেখক-ব্লগার অভিজিত রায়। তখন ছিলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলা একাডেমির বই মেলায় এসে প্রশাসনের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভিতরে থেকে পুলিশের সামনেই অভিজিতকে খুন করে জঙ্গিরা। আজ স্বাধীনতার মাসের ৩০তম দিন। অভিজিত হত্যার মাস পেরুতে না পেরুতেই মৌলবাদের থাবায় যোগ হলো আরো একটি নাম, ‘ওয়াশিকুর রহমান’। তবে অনলাইনে বন্ধুদের কাছে তিনি ওয়াশিকুর বাবু নামে পরিচিত। বরাবরের মতো এই হত্যাকাণ্ডের ধরণও ছিলো একই রকম। প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষের চোখের সামনেই কুপিয়ে হত্যা করা হল মুক্তমনা ব্লগার ওয়াশিকুর বাবুকে।
অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের সময় যদি হত্যাকারীদের আটক বা গণধোলাইয়ের মতো কোন ঘটনা ঘটতো, তবে আমরা সবকিছু হারানোর মাঝেও হয়তো কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পেতাম। টিএসসি’র মোড়ে হাজার মানুষ এবং পুলিশের সামনে অভিজিতকে হত্যা করা হলেও পুলিশ কিংবা আশেপাশের মানুষ কেউ-ই এগিয়ে আসেনি খুনিদের হাত থেকে অভিজিতকে রক্ষা করতে। এমনকি কেউ চেষ্টাও করেনি হত্যাকারীদের ধরতে।
ব্লগার ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যার পর খুনিদের দু’জন আটক হয়েছে সেখানে উপস্থিত জনতার হাতে। সহযোদ্ধার মৃত্যুর সংবাদে যতটা না শোকাহত হয়েছি, সাধারণ মানুষের হাতে হত্যাকারী আটকের খবর শুনে তারচেয়ে বেশি চমকে গেছি। কাউকে হত্যা করা হচ্ছে দেখে কেউ এগিয়ে আসবে বাঁচাতে, অভিজিত হত্যার পর এমনটা আশা করাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। খুনিরা আটক হয়েছে শুনে খুব আগ্রহ হলো তাদের চেহারা দেখার, তাদের সম্বন্ধে জানার। খুনিদের চেহারা-পোশাক বরাবরই যেমনটা হয়, এদের ক্ষেত্রেও ভিন্ন নয়। তবে জঙ্গিদের হাতে জীবন দেওয়া আরেক ব্লগার রাজীব হায়দারের খুনিদের মতো এরা কোন নামকরা প্রাইভেট ভার্সিটির ছাত্র নয়। এবারের খুনিরা মাদ্রাসার ছাত্র। খুনিদের চেহার কিংবা কর্মকাণ্ডেও ভিন্ন রকম অথবা অবাক করা কিছু ছিলো না। চমকে গেছি তাদের কথা শুনে যারা ওয়াশিকুর বাবুর খুনিদের পালিয়ে যেতে দেয়নি। যারা নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে খুনিদের আটকে রেখেছেন। ভাবছেন এরকম ঘটনাতো ঘটতেই পারে। রাস্তাঘাটে তো প্রায়ই দেখি বখাটেদের কিংবা পকেটমারদের ধরে মারছে সাধারণ মানুষরা। ইদানিংতো বাসে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে পালানোর সময় বোমাবাজদেরও ধরে গণধোলাই দেয়া হচ্ছে। তাহলে এই হত্যাকাণ্ডের খুনিদের সাধারণ মানুষের হাতে আটকের খবরে চমকপ্রদ কী আছে?
ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যা করে পালানোর সময় খুনিরা যাদের হাতে আটক হয়েছে তাঁরা ছিলেন হিজড়া! হ্যাঁ, হিজড়াদের হাতেই ধরা পড়েছে খুনিরা। সেখানে অনেক মানুষজনও ছিলো, কিন্তু খুনিদের ধরে ফেলার সাহসটা হিজড়ারা-ই দেখিয়েছেন। এই পুরো ঘটনায় আশ্চর্যের খবর এটাই। কারণ হিজড়াদের আমরা এই সমাজে সাধারণ মানুষ হিসেবে সম্মান-অধিকার দিতে পারিনি। তারা কী হিজড়া, নাকি মানুষ, নাকি অসাধারণ মানুষ? আমরা যারা ওদের হিজড়া নাম দিয়ে সমাজ-সম্মান-অধিকার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি, আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আজ তারা দেখিয়ে দিলো হিজড়ারা অসাধারণ।
মানুষ মরে গেলে তার কদর বাড়ে। ওয়াশিকুর বাবুর ক্ষেত্রেও ভিন্নতা ঘটেনি। বিভিন্ন ব্লগে তার পোস্টগুলো দেখতে নাম লিখে গুগলে সার্চ করলাম। প্রথমেই আসলো ‘সামহোয়্যার ইন ব্লগ’ এর লিংক। এই ব্লগ সাইটে বাবু পোস্ট করেছেন ৭৩টি। তার পোস্টগুলোতে পাঠকরা মন্তব্য করেছেন ১৩৪৮ বার। তিনি ৭ বছর তিন মাস থেকে এই ব্লগে লিখে আসছেন। এছাড়া অন্য ব্লগ সাইটগুলোতে আইডি দেখা গেলেও কোন পোস্ট নজরে আসেনি।
এই হত্যাকাণ্ডের পর বাকি ঘটনাগুলো আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর মতোই। লাশ পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। আইনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হবে শেষকৃত্য কিভাবে হবে সেটা নিয়ে নানা মতপার্থক্য। আর অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এধরণের ধর্মীয় হত্যাকাণ্ডের পর যেমন প্রতিক্রিয়া হয়, এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। বরাবরের মতো এবারও সবাই যুক্তি-তর্কে মেতেছে খুন হওয়া ব্লগার ওয়াশিকুর বাবু আল্লাহ-নবী-ইসলাম নিয়ে কোন বাজে কিছু লিখেছে কি লিখেনি। কেউ বলছে মুক্তমত, কেউ বলেছে কটুক্তি। কেউ কেউ আবার হত্যাকারীদের বিচার চান, কিন্তু এই চাওয়ার মাঝে অনেকবার ‘যদি-কিন্তু-তবে’আছে। জানিনা সব মুক্তমনা ব্যক্তিরা জঙ্গিদের হাতে খুন হওয়া শেষ হলে এই বিতর্ক শেষ হবে কিনা? সব মুক্তমনাদের হত্যা করা শেষ হলে খুনিরা ক্ষান্ত হবে কিনা।
লেখক-সাংবাদিক
sahos24.com | Online newspaper
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।