বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পাপ পুন্য বিচার
সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিব
আজম খান
প্রিন্টঅঅ-অ+
সিঙ্গাপুর স্বাধীনতা লাভ করে ৩১’শে আগষ্ট ১৯৬৩ সাল। কিন্তু ১৯৫৯ সাল থেকে তারা স্বাধিকার লাভ করে। আমাদের যেমন শেখ মুজিব তাদের তেমনি লি কুয়ান ইউ। তাকে অবশ্য শেখ মুজিবের মত জীবনের দুই দশক জেলে কাটাতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর ব্রিটিশরা একে একে তাদের উপনিবেশগুলো ত্যাগ করছিলো। । রাজনৈতিক ব্যাস্ততা এবং কর্মসুচি ছাড়া তাকে তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি।
লি কুয়ান ১৯৫৯ সালে স্বাধিকার অর্জনের প্রথম দিনটি থেকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী। টানা ৩০ বছর শাসন করেছেন তিনি। গণতন্ত্র কি খায় না মাথায় দেয় তার শাসনামল শেষ হবার আগ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের মানুষ জানতে পারেনি। তারা চেয়েছিলো বলেও মনে হয় না। মাঝেমধ্যে কিছু প্রতিবিপ্লবী এবং অতি বিপ্লবীরা গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার চাইলেও তাদের ঠিকানা হয়েছে হয় মাটির তলে, নয়তো সমুদ্রে মাছের খাদ্য হয়ে অথবা লাল দালানের ভাত খেয়ে। সিঙ্গাপুর যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন তার সম্পদ বলতে একটি সামুদ্রিক বন্দর এবং সামুদ্রিক মাছ। চরম দরিদ্র অবস্থা। সে তুলনায় একাত্তরের যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ছিলো ঢের বেশী। হেনরি কিসিঞ্জার তখনকার বাংলাদেশকে বলেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি। সিঙ্গাপুরের তলা দূরে থাক। ঝুড়িটাও ছিল না স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে।
স্বাধীনতার পরপর সিঙ্গাপুরের মানুষ বছরের পর বছর অভাব, কষ্ট সহ্য করেছে। সাথে ছিল ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কলোনিয়াল সিস্টেমের উচ্ছিষ্ট। যার দরুন সুশাসন এবং দুর্নীতির প্রকোপ। ঠিক যেমনটা আমরা দেখেছি আমাদের জাতির স্বাধীনতার পরে। তাতে লি কুয়ান দমে যাননি। দমে যায়নি তার অনুসারীরাও। দাঁতে দাঁত চেপে প্রায় দুই দশকের পরিশ্রমে তারা দুর্নীতি, অভাব সবকিছুকে ঝাঁটাপেটা করে বিদায় করে। তিন দশকের মাথায় লি কুয়ান সিঙ্গাপুরকে পরিনত করেন এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশ হিসেবে। এখন সিঙ্গাপুর মাথা পিছু আয়ের দিক থেকে পুরো পৃথিবীতে দ্বিতীয়। তাদের সমদ্র বন্দর বিশ্বের সবচাইতে ব্যাস্ততম বন্দর। তেল শোধনে সিঙ্গাপুর বাঘা বাঘা দেশকে পেছনে ফেলে তৃতীয়।
উল্টোদিকে, যদি আমাদের স্বাধীনতার পরের ইতিহাস দেখি তবে যেন শুরুটা একই গল্পের পুনরাবৃত্তি। সেই অভাব, সেই দুর্নীতি আর সুশাসনের অভাব এবং কলোনিয়াল মানসিকতার যথেচ্ছাচার লুটপাট। আমাদের গল্পে অবশ্য স্বাধীনতা বিরোধীদের ভুমিকা আছে। যা সিঙ্গাপুরের গল্পে নেই। অতি বিপ্লবীরা অবশ্য ছিল। উনারা কবে কোথায় না ছিলেন। সিঙ্গাপুরের মানুষ জানতো লি কুয়ানের হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই। শত বছরের শোষিত দেশের কাঠামো নতুন করে দাঁড় করাতে সময় লাগবে। তারা জানতো যে মানুষটা দেশের স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ, তিতীক্ষায় বিন্দুমাত্র অবহেলা করেননি তার চাইতে উপযুক্ত শাসক আর পাওয়া যাবে না। তাই লি কুয়ান যখন একদলীয় শাসন চালু করলেন যাবতীয় অবক্ষয় রোধে এবং বৃহত্তর স্বার্থে কেউ গণতন্ত্রের জন্য আমাদের মত স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে সুরে সুর মিলিয়ে মায়াকান্না করেনি।
লি কুয়ান যা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর চাইতে উত্তম কাঠামো দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। সর্বদলীয়, সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহনে তৈরী করেছিলেন বাকশাল। তৎকালীন দ্বিতীয় বৃহত্তম দল সিপিবি হতে শুরু করে আরো অনেক দল যোগ দেয় তাতে। এমনকি অধুনা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান পর্যন্ত বাকশালের একজন গুরুত্বপুর্ন সদস্য ছিলেন। যদিও তার দলই পরবর্তীতে লুকিয়ে থাকা পরাজিত শক্তি এবং প্রাক্তন মুসলিম লীগারদের সাথে একত্রিত হয়ে নানা সময়ে বাকশালের নিন্দে-মন্দ করেছিলেন। এমনকি হাস্যকর হলেও সত্যি, এই সময়ে এসেও তারা সেই রাজনীতিটাই চালু রেখেছে।
লি কুয়ানের মানুষেরা গণতন্ত্র চায়নি। তারা আস্থা রেখেছিলো তাদের নেতার প্রতি। সন্তান যেমন আস্থা রাখে পিতার স্নেহ এবং ভালবাসার উপরে। অন্যদিকে আমাদের এখানে গণতন্ত্রের নামে কি-না হয়েছে। পাটের গুদামে আগুন হতে শুরু করে মানুষ খুন। এক সময়ে গণতন্ত্র উদ্ধার, দুর্নীতি মুক্ত করার নাম করে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলো খুনীরা। রেডিও’তে ঘোষনা আসলো- ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। এবার আসমান থেকে আসমানী খাদ্যের মত করে উড়ে উড়ে ভাত ঘরে ঘরে ঢুকবে। ঘরে ঘরে হীরা, মানিক্য, মনি-মুক্তার বৃষ্টি বইবে। গণতন্ত্রের স্বর্নযুগ শুরু হবে। অথচ এই সেদিনও এক উত্তরাঞ্চলে মঙ্গায় মানুষ মারা গেছে অজস্র। কেউ একবার খোজও নেয়নি। যেন অনেকটাই মাথায় হাত বুলিয়ে...
এখন ২০১৫ সাল। শেখ মুজিবকে খুনের ৪০ বছর পার হয়ে যাবার পথে। হা হতোস্মি! ইলেকশনের দিন ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেও আমি জানি না আমার ভোট অন্য কেউ দিয়ে গেছে কিনা। ঘর থেকে বের হবার আগে চিন্তা করি রাতে কি অক্ষত দেহে এই ঘরে প্রবেশ করবো নাকি কয়লা। দুর্নীতি আগের চাইতে বেড়েছে। এই দেশের বাতাসও ঘুষ ছাড়া নড়ে না। অথচ, সিঙ্গাপুর? শুদ্ধ গণতন্ত্রের চর্চায় তারা পৃথিবীতে তিনে। দুর্নীতি নেই বললে চলে।
আমরা শেখ মুজিব বুঝি নাই। বুঝেছিলাম গণতন্ত্র। সিঙ্গাপুরের মানুষেরা গণতন্ত্র চায় নাই। চেয়েছিলো লি কুয়ান ইউকে। আজকে তাদের লি কুয়ান মারা গেছে। কিন্তু রয়ে গেছে শক্ত ভিতে দাঁড়ানো অর্থনীতি এবং গণতন্ত্র।
নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, শেখ মুজিবকে যারা খুন করেছিলো তারা মুখে বলেছিলো গণতন্ত্র এবং দুর্নীতির কথা। কিন্তু তারাই এই হত্যার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করেছিলো অদূর ভবিষ্যতেও যাতে বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতন্ত্রের চর্চা না হয়, দুর্নীতির সর্বগ্রাসী চেহারা যেন দিনে দিনে জমকালো হয়ে আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। আজকে চারপাশে তাকাই আর হাহাকার করে বলি- হা শেখ মুজিব, হা জাতির পিতা! লি কুয়ান তার কাজ শেষ করে গেছে। তুমি পারনি। আমরা দেইনি। আজ আমরা নিষ্পাপেরাও তাই জীবন্ত নরকে জ্বলে পুড়ে মরছি।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।