হারিয়ে যাচ্ছে কাউখালীর ঐতিহ্য সোনাকুরের মৃৎ শিল্প
কাউখালী উপজেলা সোনাকুর গ্রামের মৃৎশিল্প বহুমুখী সমস্যায় পড়ে তার হাজার বছরের ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। পূঁজির জন্য মহাজনি ঋনের চক্রে জড়িয়ে পরছে কুমাররা। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও নতুন নতুন শিল্প সামগ্রীর প্রসারের কারনে এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুকুল বাজারের অভাবে মৃৎশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে।
জেলার একটি ছোট উপজেলা কাউখালী। এ উপজেলার সন্ধ্যা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোনাকুর গ্রাম, যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা একটি স্বর্ণালী ছবি। কাউখালী নদী বন্দর থেকে পশ্চিম বা লঞ্চ ঘাটে দাড়ালে বা চলমান জলযান থেকে নদীর পশ্চিম পাড়ের সোনাকুরের সারিবদ্ধ ছোট ছোট কুটিরের নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ে। সোনাকুর গ্রামে প্রায় ৭০/৭৫ টি পরিবার আছে এবং প্রত্যেক পরিবারে গড়ে প্রায় ৭ জন করে সদস্য আছে এবং লোক সংখ্যা প্রায় ৮/৯ শত। সোনাকুর বৃহত্তর বরিশালের একমাত্র মৃৎ শিল্পের বড় গ্রাম হিসাবে পরিচিত।
মৃৎশিল্পে সাথে কাউখালী উপজেলার সোনাকুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ জড়িত। কুমারদের পাশাপাশি এলাকার অনেক মুসলমান নারী মানুষ শিশু এ পেশার শ্রম বিক্রি করে। দেখা যায় এদের জীবন যাত্রার মান খুবই নিম্নমানের। কোন ক্রমে খেয়ে পড়ে বেচে আছে এবং বেছে থাকার জন্য দিনে ১৮ ঘন্টা হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। পরিবারগুলো মাস জুড়ে হাঁড়ি-পাতিল, সরা, লোটা, কলস, ঝাঁঝর, ফুলের টবসহ বিভিন্ন ধরনের মাটির সামগ্রী তৈরি করে শুকানোর পর আগুনে পুড়িয়ে সেগুলো বিভিন্ন হাট-বাজারে নিয়ে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। বর্তমানে অ্যালুমিনিয়াম, প্লস্টিক ও স্টিলের জিনিসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। শত অভাবের মধ্যেও এ সম্প্রদায়ের অনেকেই এখনো পূর্বপুরুষের এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন। তাদের অবস্থা বর্তমানে খুবই করুন। ময়লা ও ছেঁড়া কাপড় থাকে তাদের পরনে। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে পুষ্টিহীনতায় জীর্ণ-শীর্ণ শিশুদের চোখে-মুখে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার আকুতি। এসব কুমার অধিকাংশই ভূমিহীন। অনেকের আবার নিজেদের বসবাসের জন্য সামান্য ভিটেটুকু ছাড়া তাদের অন্য কোনো জমি-জমা নেই।
যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মাটির জিনিষপত্র তার পুরানো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। ফলে এ পেশায় জড়িত বিশেষ করে এটাই যাদের জীবীকার একমাত্র অবলম্বন তাদের জীবন যাপন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশর বিভিন্ন অঞ্চলের মতো কাউখালী উপজেলার সোনাকুর গ্রামের মৃৎশিল্পের নিয়োজিত কুমাররা অধিকাংশই পাল সম্প্রদায়ের। প্রাচীন কাল থেকে ধর্মীয় এবং আর্থ সামাজিক কারনে মৃৎশিল্পে শ্রেনীভূক্ত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা মৃৎশিল্পকে পেশা হিসাবে গ্রহন করে। এ গ্রামের বলতে গেলে সকলেই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত। কয়েক’শ বছর আগে এ শিল্পের সাথে জড়িত হয় গ্রামের কুমাররা। তারা জীবীকার একমাত্র অবলম্বন হিসাবে গ্রহন করে এই মৃৎশিল্পকে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনাতার যুদ্ধের পর অনেক পাল সম্প্রদায়ের পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে চলে গেছে। বর্তমানে সামান্য সংখ্যক পাল পরিবার সোনাকুর গ্রামে বসবাস করছে। এ শিল্পের সাথে জড়িত কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, জ্বালানী কাঠ, মাটি, শ্রমিকের মঞ্জুরী রং পোড়ানো ও পরিবহনসহ প্রতিটি কাজ করতেই টাকার দরকার হয়। ফলে এ পেশার সম্প্রসারন নয় বরং সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। এ পেশার উৎকর্ষতা ধরে রাখার জন্য সরকার যে ঋণ চালু রেখেছেন তার সুফল প্রকৃত পেশাজীবীরা পাচ্ছে না।
অনন্ত কুমার পাল, নারায়ন চন্দ্র পাল, কালি দাস পাল, হরিদাস পাল, কমলা রানী পাল তদ্বির ছাড়া ঋন পাওয়া যায়না বলে অভিযোগ করলেন। তারা জানান, বাজারে এখন আর আগের মতো মাটির জিনিষ পত্রের চাহিদা তেমনই নেই ।
এর স্থান দখল করেছে দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তেজসপত্র। ফলে বিক্রেতারা মাটির জিনিষপত্র আগের মতো আগ্রহের সাথে নিচ্ছেনা। তাদের চাহিদা নির্ভর করে ক্রেতাদের উপর। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জের অঁজ পাড়াগাঁ পর্যন্ত এখন আর মাটির হাড়ি পাতিলের তেমনটা চোখে পড়ে না। সে কারনে অনেক পুরানো শিল্পীরা ও পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। কেউ রিক্সা চালায়, কেউবা দিন মজুরী করে জীবীকার পথ দেখছে। তাছাড়া সন্ধ্যা নদীর তীব্র ভাঙ্গনে গ্রামের অধিকাংশ ঘরবাড়ী নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সংকুচিত হয়ে আসছে তাদের গ্রাম।
সরেজমিন কুমারপাড়া গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই ব্যস্ত আছেন হাঁড়ি-পাতিল, কলস, চারিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তাদের বিষাদময় জীবন কাহিনী। তারা বলেন, অনেকেই সুখ-দুঃখের, সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে যান। কিন্তু পরে আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। ওই পাড়ার কালি দাস পাল জানান, সারামাস হাঁড়ি-পাতিল, কলস সহভিন্ন প্রকার পুতুলসহ মাটির সামগ্রী তৈরি করে শুকানোর পর ভাটার আগুনে পুড়িয়ে সেগুলো বাজারজাত করা হয়। হাঁড়ি-পাতিলের চেয়ে চারি’র (গো-খাদ্যের পাত্র) চাহিদা বেশি। যা দিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন তারা। দুঃখ-কষ্টের মাঝে দিন কাটলেও কাউখালীর মৃৎ শিল্পীরা এখনও স্বপ্ন দেখেন একদিন আবার কদর বাড়বে মাটির পন্যের। সেদিন হয়তো আবারো তাদের পরিবারে ফিরে আসবে সুখ-শান্তি। সেই দিনের অপেক্ষায় তারা কষ্ট করে যাচ্ছেন।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।