চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন
বঞ্চিত কৃষক ও বঞ্চক ভদ্রলোকদের জন্য আগাম বার্তা
যতীন সরকার
প্রিন্টঅঅ-অ+
২০১৪ সালের শেষ মাসটিতেই একটি বার্তা শুনে মন আনন্দে আপ্লুত হয়ে যায়। সেই আনন্দবার্তাকে চিত্তে ধারণ করেই ২০১৫ সালটিকে বরণ করে নিই। সেই আনন্দবার্তাটি হলো : আমরা এখন আর খাদ্যঘাটতির দেশের বাসিন্দা তো নই-ই, বরং আমাদের দেশটি খাদ্য-রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় চাল রপ্তানির মধ্য দিয়েই আমাদের সেই মর্যাদার সূচনা ঘটেছে।
এই বার্তাটি পেয়েই 'বার্তা' শব্দের আদি অর্থটিও চকিতে আমার মনের কোণে হানা দেয়। বর্তমানে যদিও আমরা বার্তা বলতে খবর বা সংবাদকে বুঝে থাকি, আদিতে কিন্তু শব্দটির অর্থ ছিল 'কৃষি', কৃষকই ছিল বার্তার স্রষ্টা ও পোষ্টা, কৃষকই বার্তাজীবী ও বার্তাবহ। মৃত্তিকা কর্ষণ করে বীজ রোপণ ও বপনের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন তথা কৃষি থেকেই কৃষ্টি। সেই কৃষি ও কৃষ্টিবিষয়ক শাস্ত্রেরই নাম 'বার্তাশাস্ত্র'। সেই শাস্ত্রের ধারকদের কৃতিত্বেই আমাদের দেশ ও জাতি মর্যাদাবান।
কিন্তু প্রশ্ন, প্রতিনিয়ত আমাদের মর্যাদাবান করে আসছে যারা, তাদের আমরা কতটুকু মর্যাদা দিয়েছি ও দিচ্ছি? মর্যাদা দেওয়া তো দূরের কথা, অনবরত তাদের মর্যাদাকে ধুলায় লুটিয়ে দিতেই কি আমরা তৎপর থাকিনি? তাদের মর্যাদা হরণের বিবিধ উপায়-অন্বেষণেই কি আমরা ব্যাপৃত নই?
এই 'আমরা' মানে 'মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ', অথচ 'মাটির মালিক'। বিচিত্রবিধ ছল-বল-কৌশল অবলম্বনেই আমাদের এই মালিকানা লাভ। এই অন্যায় মালিকানা টিকিয়ে রাখার জন্যই নব নব অন্যায়ের আশ্রয় আমরা নিচ্ছি, আর অন্যায়কেই ন্যায়ের শিরোপা পরিয়ে দিচ্ছি। এমনকি ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রটিতে পর্যন্ত আমাদের অন্যায় আচরণের বিস্তৃতি ঘটিয়েছি। সচেতন প্রক্রিয়াতেই কৃষি সম্পর্কীয় নানা শব্দের আদি অর্থকে যেমন বিস্মৃতির অন্ধকারে আবৃত করেছি, তেমনি অনেক শব্দের অর্থে ও উচ্চারণেও বিকৃতি ঘটিয়ে ফেলেছি। কৃষিকর্মকে 'বার্তা' ও কৃষিকর্মে দক্ষ মানুষকে 'বার্তিক' বলে পরিচয় দেওয়ার রীতি তো অনেক আগেই আমরা পরিত্যাগ করেছি, কৃষিজীবীদের পরিচয়-জ্ঞাপক 'চাষি' শব্দটিকেও বিকৃত করে বলছি 'চাষা'। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ছাড়িয়ে চাষার ব্যবহারিক অর্থ হয়ে গেছে- মূর্খ, অমার্জিত, অসভ্য। পরিশ্রমজীবী অন্ন-উৎপাদক চাষিদের চাষাভূষা ও 'ছোটলোক' আখ্যা দিয়ে আমরা পরশ্রমজীবীরা আত্মপরিচয় দিচ্ছি 'ভদ্রলোক' বলে।
তবে এই ভদ্রলোকদের সবাই যে কৃষি ও কৃষকের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন, তা নয়। এই ভদ্রলোকগোষ্ঠীর ভেতর থেকেই তো মার্ক্সপন্থী সমাজ বিপ্লবীদেরও অভ্যুদয় ঘটেছে, সেই বিপ্লবীদের অনেকেই জমির মালিকানা পরিত্যাগ করে মেহনতি কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। আমাদের দেশে মার্ক্সপন্থা প্রচারিত হওয়ার অনেক আগেও এখানকার অনেক প্রজ্ঞাবান মনীষীই সামাজিক বৈষম্যবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষকদের দুরবস্থার জন্য ভূস্বামীদের দায়ী করেছিলেন। যেমন, ১৮৫১ সালেই 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকায় উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি চিন্তাবিদ অক্ষয় কুমার দত্ত লিখেছিলেন-
"ভূমিই আমাদের মূলধন, এবং কৃষকেরাই আমাদের প্রতিপালক। কিন্তু কি আক্ষেপের বিষয়! যাহারা এমন হিতৈষী,- সংসারের এমন সুখ-সঞ্চারক, তাহাদের দারুণ দুর্দশা দেখিয়া হৃদয় ব্যাকুল হয়। তাহারা ভুবন প্রতিপালক হইয়াও আপনাদের উদরান্ন আহরণে সমর্থ হয় না; এক দিবসও নিরুদ্বেগে সুখে যাপন করিতে পারে না। ইহার কারণ অতি ভয়ানক, এবং ইহার অনুসন্ধান করাও যন্ত্রণাজনক।... 'যে রক্ষক সেই ভক্ষক' এ প্রবাদ বুঝি বাঙ্গালার ভূস্বামীদিগের ব্যবহার দৃষ্টেই সূচিত হইয়া থাকিবেক। ভূস্বামী স্বাধিকারে অধিষ্ঠান করিলে প্রজারা একদিনের নিমিত্ত নিশ্চিন্তে থাকিতে পারে না; কি জানি কখন কি উৎপাত ঘটে ইহা ভাবিয়াই তাহারা সর্বদাই শঙ্কিত।"
বঞ্চিত কৃষক ও বঞ্চক ভদ্রলোকদের জন্য আগাম বার্তা
কৃষক-প্রজাদের এ রকম 'শঙ্কিত' থাকার কারণ নির্দেশ করে অনেক বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন উনিশ শতকের বাংলার 'সাহিত্যসম্রাট'রূপে খ্যাত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। 'তত্ত্ববোধিনী'তে অক্ষয় কুমারের রচনাটি প্রকাশের বছর পঁচিশেক পরে বঙ্কিমচন্দ্র 'বঙ্গদর্শন'-এ লেখেন-
"জীবের শত্রু জীব; মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য; বাঙ্গালি কৃষকের শত্রু ভূস্বামী। ব্যাঘ্রাদি বৃহজ্জন্তু, ছাগাদি ক্ষুদ্র জন্তুগণকে ভক্ষণ করে; রোহিতাদি বৃহৎ মৎস্য, সফরীদিগকে ভক্ষণ করে; জমিদার নামক বড় মানুষ, কৃষক নামক ছোট মানুষকে ভক্ষণ করে। জমিদার প্রকৃতপক্ষে কৃষকদিগকে ধরিয়া উদরস্থ করেন না বটে, কিন্তু যাহা করেন, তাহা অপেক্ষা হৃদয়শোণিত পান করা দয়ার কাজ। কৃষকদিগের অন্যান্য বিষয়ে যেমন দুর্দ্দশা হোক না কেন, এই সর্বরত্নপ্রসবিনী বসুমতী কর্ষণ করিয়া তাহাদিগের জীবনোপায় যে না হইতে পারিত, এমন নহে। কিন্তু তাহা হয় না; কৃষক পেটে খাইলে জমিদার টাকার রাশির উপর টাকার রাশি ঢালিতে পারেন না। সুতরাং তিনি কৃষককে পেটে খাইতে দেন না।"
অথচ পাবনায় জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক-বিদ্রোহ শুরু হলে এই বঙ্কিমই মীর মশাররফ হোসেন রচিত 'জমিদার দর্পণ' নাটকটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। ১২৮০ সালের ভাদ্র সংখ্যা 'বঙ্গদর্শন'-এ তিনি লিখলেন-
"বঙ্গদর্শনের জন্মাবধি এই পত্র প্রজার হিতৈষী। এবং প্রজার হিতকামনা আমরা কখনো ত্যাগ করিব না। কিন্তু আমরা পাবনা জেলার প্রজাদিগের আচরণ শুনিয়া বিরক্ত এবং বিষাদযুক্ত হইয়াছি। জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। আমরা পরামর্শ দিই যে, এ সময়ে এ-গ্রন্থ বিক্রয় ও প্রচার বন্ধ করা কর্তব্য।"
'প্রজার হিত কামনা' করেন যিনি, তিনিই অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী 'প্রজাদিগের আচরণ শুনিয়া বিরক্ত ও বিষাদযুক্ত' হন, আর অত্যাচারীদের স্বরূপ উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে লিখিত সাহিত্যকর্মের প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। শুধু বঙ্কিম নন, সেকাল ও একালের সমাজে কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠী তথা 'ভদ্রলোকদের' প্রায় সবারই এ রকম মনোভঙ্গি। ব্রিটিশ শাসনে ও পাকিস্তানি শাসনামলে আমাদের এ দেশে ভদ্রলোকগোষ্ঠীর একটি সচেতন অংশ রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। সেই সংগ্রামে সফলতা লাভের জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকদের সক্রিয় সহায়তা। সে রকম সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যেই কৃষকদের ন্যায্য অধিকারপ্রাপ্তির কথা তারা উচ্চকণ্ঠে বলতে থাকে, অনেক অনেক প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেয়। সেসব প্রতিশ্রুতিতে কৃষক সমাজ অনুপ্রাণিতও হয়। তারই ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম- উভয় ক্ষেত্রে কৃষকই নেয় অগ্রণী ভূমিকা। অথচ পাকিস্তানের মতো স্বাধীন বাংলাদেশেও মেহনতি কৃষকরাই হয় সর্বতোভাবে প্রতারিত ও বঞ্চিত। প্রতারক ও বঞ্চক ভদ্রলোকরাই কৃষকের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলেও খেয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশেও খাচ্ছে।
কৃষকদের নানা কৌশলে প্রতারণা করেই কিভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মধ্বজীরা পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল, সেই পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের প্রধান অংশটি কেন পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিল এবং নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের তাগিদেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তারা কিভাবে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল, এখানে সেসব ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করার সুযোগ নেই। তবু ইংরেজ আমলে স্বাধীনতাসংগ্রামী হিন্দু ভদ্রলোক তথা কংগ্রেস দলের জমিদার-মহাজন ও অভিজাত নেতারা যে কৃষক-প্রজার অধিকার মেনে না নিয়ে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কৃষক-প্রজাদের কংগ্রেসের প্রতি বিমুখ করে তুলেছিলেন এবং এভাবেই যে তাদের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন, এ বিষয়টি সম্পর্কে প্রখ্যাত চিন্তাবিদ অতুল চন্দ্র গুপ্তের 'জমির মালিক' বইটি থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করছি-
'মহাত্মার প্রথম অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার চাষী, যাদের অধিকাংশ মুসলমান, কংগ্রেসের ডাকে প্রবল সাড়া দিয়েছিল, কংগ্রেসকে মনে করেছিল নিজের জিনিস। তেমন ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটেনি। এই অভূতপূর্ব অবস্থার সুযোগেও বাংলার কংগ্রেস নেতারা বাংলার রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি ও আন্দোলনকে ধর্মভেদের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেবার কোনো চেষ্টাই করেননি। নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থের চিন্তা তাদের বুদ্ধিকে অন্ধ ও কর্মকে পঙ্গু করেছিল। বাংলার চাষীর অনায়াস লভ্য নেতৃত্ব বাংলার কংগ্রেসের পক্ষে অসাধ্য হয়েছিল। ১৯২৮ সালের আইন সংশোধনের ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ হলো বাংলার আইনসভার কংগ্রেসী সভ্যদের কাছে চাষীর স্বার্থের চেয়ে জমিদারের স্বার্থ বড়।'
এর ফলেই সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ দলটির পক্ষে বাংলার মুসলমান কৃষক-প্রজাদের সমর্থনপ্রাপ্তি একান্ত অনায়াস লভ্য হয়ে ওঠে। সেই অনায়াস লভ্য সুযোগকে কাজে লাগিয়েই মুসলমান কৃষকদের সামনে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের এক মোহনীয় রূপ তুলে ধরে। সেই কল্পরূপে মোহগ্রস্ত কৃষকদের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়েই মুসলিম লীগ পাকিস্তানের মতো একটি সাম্প্রদায়িক অপ-রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে ফেলে। হিন্দু ভদ্রলোকদের স্থলে সেই অপ-রাষ্ট্রের ক্ষমতার আসনে বসে যায় মুসলমান ভদ্রলোক বা শরিফ আদমিরা। কৃষকদের সঙ্গে তাদের আচরণে তারা আগেকার ভূস্বামীদেরই পন্থানুসরণ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। সেই দুর্ভিক্ষের মুখেই সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের জন্য বাধ্যতামূলক বিক্রি বা 'লেভি' ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। এই ব্যবস্থায় সরকার ধানের যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, তা ছিল প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে অনেক কম। এর ফলে কৃষক ধান উৎপাদন করেও নিজের ভোগে তা লাগাতে পারে না, বরং নিজের উৎপাদিত ধান জলের দরে বিক্রি করে প্রয়োজনের সময় সেই ধানই তাকে বাজার থেকে চড়া দামে কিনতে হয়।
এ সময়েই প্রবর্তিত হয় 'পূর্ব বাংলা জমিদারি ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন'। এ আইনে জমিদারিব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদের পরিবর্তে রাষ্ট্রই জমিদারে পরিণত হয়ে যায় এবং কৃষকের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহগুলোকে দমনের জন্য রাষ্ট্রশক্তি যে ধরনের অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়, নৃশংসতায় ও বর্বরতায় তা আগেকার ভূস্বামীদের আচরণকেও ছাড়িয়ে যায়।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রবিধায়করা মেহনতি কৃষকদের তো প্রবঞ্চিত করেই, তাদের প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে সব শ্রেণি-পেশার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজনই। বিশেষ করে রাষ্ট্রটির পূর্ব অঞ্চলে সে প্রবঞ্চনা একেবারে সীমা ছাড়িয়ে যায়। এ রকম সীমাহীন প্রবঞ্চনার হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এ অঞ্চলের মানুষকে পাকিস্তানের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে নামতে হয়। সে সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী ভদ্রলোকরাও কৃষকদের সামনে মোহনীয় ভবিষ্যতের রূপকল্প তুলে ধরেন। এতে বিশ্বাস স্থাপন করে সর্বস্তরের কৃষক সর্বশক্তি নিয়ে সে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে।
কিন্তু অপরিমেয় ধন-মান-প্রাণের মূল্যে অর্জিত এই স্বাধীন রাষ্ট্রটিতেও কি মেহনতি কৃষকের ভাগ্যে কোনো সদর্থক পরিবর্তন ঘটেছে? স্বাধীন রাষ্ট্রের কি কৃষকের বাঁচার মতো বাঁচার স্বাধীনতা অপহরণ করে নিয়ে যায়নি লুটপাটতন্ত্রী শাসনব্যবস্থার ধারক-বাহকরা? রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আসনে যাঁরা চিরস্থায়ী হয়ে থাকতে চান কিংবা যেকোনো উপায়ে সেই ক্ষমতা দখল করতে চান যাঁরা, তাঁদের কারো কাছেই কি কৃষকের জীবনের কোনো মূল্য আছে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর সর্বজনজ্ঞাত। শ্রীলঙ্কায় চাল রপ্তানির যে বার্তা দিয়ে এই লেখাটি শুরু করেছিলাম, কৃষক শুধু এইটুকু বার্তাই বহন করে আনেনি। বিগত চার দশকে যে দেশে ৬৫ হাজার কৃষিজমি কমে গেছে, সেই দেশেই তো শস্য উৎপাদন কমার বদলে বেড়েছে। ১৯৭০ সালে যে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হতো এক লাখ টনের মতো, সেই দেশেই তো সে উৎপাদন এখন প্রায় তিন লাখ টন। কেবল খাদ্যশস্যসহ কৃষিজাত সব পণ্যের উৎপাদন বাড়েনি, বেড়েছে মাছের উৎপাদনও। মিঠা পানির মাছের উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান এখন চতুর্থ। গত ১০ বছরে ১০ গুণ বেড়েছে নদীতে ইলিশের উৎপাদন। গাঁয়ের শস্যচাষি ও মৎস্যচাষিদের পুত্র-কন্যারাই শহরে বস্ত্রশিল্পের শ্রমিক রূপে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। বিদেশে গিয়েও তারাই হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা দেশে নিয়ে এসেছে।
অর্থাৎ দেশের জন্য যা কিছু শুভবার্তা, তার সবই বহন করে এনেছে কৃষক ও তাদের পুত্র-কন্যারা। আর আমরা ভদ্রলোকের দল এর প্রতিদানে তাদের জন্য কেবলই অস্বস্তির বার্তা উপহার দিচ্ছি। ২০১৪ সালের শেষ মাসটিতে কৃষকবাহিত যে বার্তা আমাদের চিত্তে আনন্দের আলোকপ্রবাহ বইয়ে দিয়েছিল, ২০১৫ সালের শুরু থেকেই সেই বার্তাবাহকদের আমরা বিষাদের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছি। ক্ষমতার নীতিহীন রাজনীতি দিয়ে আমরা দেশে যে অবরোধের আগুন জ্বেলেছি, সেই আগুনেই পুড়ে মারছি তাদের। অবরোধে আটকা পড়েছে তাদের হাতে উৎপাদিত সব ভোগ্যদ্রব্য, আর এর ফলে তাদের জীবনে কেবল ভোগান্তিই সার হচ্ছে। সেই ভোগান্তির হাত থেকে ভদ্রলোকদের কোনো দল ও গোষ্ঠীরই রেহাই মিলবে না। সার ও কীটনাশকসহ উৎপাদনসহায়ক উপকরণপ্রাপ্তি থেকে কৃষকদের বঞ্চিত করছে যারা, সেই বঞ্চকদেরও বঞ্চিত হতে হবে খাদ্য-বস্ত্রসহ জীবনধারণের সব উপকরণ থেকে।
জীবনের জন্য কোনো বার্তাই সেদিন পাওয়া যাবে না। তাই সেদিনই বোধ হয়, বার্তা শব্দটির আদি অর্থের তাৎপর্য সবার বোধগম্য হবে। তবে মনে রাখতে হবে, এটিই শেষ কথা নয়। অন্তত কৃষকের জন্য তো নয়ই। পরিশ্রমজীবী কৃষক-মজুররাই পারবে পরশ্রমজীবী ভদ্রলোকদের বঞ্চনা ও প্রতারণার অবরোধ ভেঙে ফেলে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত নতুন সমাজের বার্তা বয়ে আনতে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।