বিচারপতিকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত মণিপুরী সম্প্রদায়
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুর গ্রামের কীর্তি পুরুষ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা (সুরেন্দ্র কুমার সিংহ)-কে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনসহ পুরো কমলগঞ্জ উপজেলাবাসী। প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এটাই তার প্রথম কমলগঞ্জ সফর।
আজ ৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার তিনি কমলগঞ্জে আসছেন। গোটা এলাকায় সাজ সাজ রব বিরাজ করছে। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বাংলাদেশের বৃহত্তর মণিপুরী সমাজ (বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও পাঙাল) এর পক্ষ থেকে আজ বিকেলে রানীর বাজারস্থ দয়াময় সিংহ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এলাকায় তাঁর আগমন উপলক্ষে বেশ কয়েকটি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে আজ শুক্রবার সকাল ৯টায় আলীনগর ইউনিয়নের তিলকপুর মণিপুরী পল্লীর প্রবেশদ্বারে মণিপুরীদের সম্পূর্ণ সামাজিক রীতি অনুযায়ী ১কি:মি: এলাকা জুড়ে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে শত শত মনিপুরী তরুণ-তরুণী ফুল ছিটিয়ে তাঁকে বরণ করে নিজ বাসভবন “আশীর্ব্বাদ” গেট পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
এরপর সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টচা পর্যন্ত অভ্যর্থনা মঞ্চে মণিপুরী পালা কীর্তন অনুষ্ঠিত হবে। বিকাল ৩টা থেকে মণিপুরী সম্প্রদায়ের বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও পাঙাল সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে অনুষ্ঠিত অভ্যর্থনা শেষে মণিপুরী ললিতকলা একাডেমি ও মণিপুরী থিয়েটারের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখানে মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন ছাড়াও কমলগঞ্জ উপজেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন।
অভ্যর্থনা কমিটির আহবায়ক সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ এর উপাধ্যক্ষ ডা. নন্দকিশোর সিংহ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে অভ্যর্থনা জানাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন উপস্থিত থাকবেন। তাকে অভ্যর্থনা জানাতে তিনটি মণিপুরী সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। অনুষ্ঠান মঞ্চে অন্যদের মধ্যে প্রধান বিচারপতির সহধর্মিণী সুষমা সিনহা, বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ, জেলা প্রশাসক, জেলা ও দায়রা জজ, পুলিশ সুপার, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপস্থিত থাকবেন।
অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য সচিব বিশ্বজিত সিংহ জানান, অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ হলো ৪ মণ ওজনের রাজঘন্টা বাজানো। প্রায় সাড়ে ৪শত বছর পূর্বে রাজ পরিবারে বাজানো এই রাজ ঘণ্টা। প্রধান বিচারপতির অভ্যর্থনাকে কেন্দ্র করে তিনটি মণিপুরী সম্প্রদায়ের মিলন মেলা উৎসবে পরিণত হবে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের নিভৃত এক গ্রাম তিলকপুর। এই গ্রামটিতে শিক্ষার আলো জ্বলছিল অনেক আগে থেকেই। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ায় ‘বিদ্যাসাগর’ নামে অন্য পরিচয়ও রয়েছে গ্রামটির। শত ভাগ শিক্ষিতের সে ‘বিদ্যাসাগরে’ই প্রথম সাঁতার কাটার শুরু সুরেন্দ্র কুমার সিনহার। ১৯৫১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। স্কুল শিক্ষক ললিত মোহন সিনহা ও ধনবতী সিনহার দ্বিতীয় সন্তান এস কে সিনহা পড়ালেখার পাঠ শুরু করেন গ্রামের রানীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হন কমলগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর এস কে সিনহা গ্রাম ছেড়ে আসেন সিলেটে। শিক্ষার্থী হিসেবে নাম লেখান সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ মদন মোহন কলেজে। সেখান থেকে ১৯৬৮ সালে পাস করেন উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৭০ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলএলবি ডিগ্রি নেওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ১৯শে ডিসেম্বর আইন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি। আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন সিলেট জেলা জজ কোর্টে। ১৯৭৮ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে নাম লেখান তিনি। ১৯৯০ সালে এস কে সিনহার পরিচিতি হয় আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে। ১৯৯৯ সালের ২৪শে অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দেন এস কে সিনহা। ১০ বছর পর ২০০৯ সালের ১৬ই জুলাই তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এস কে সিনহা স্বপ্নের শেষ সীমা ছুঁলেন গত ১৭ই জানুয়ারি, বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি।
তবে সবার চেয়ে একটু আলাদাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহা- যার ছোট্ট নাম এস কে সিনহা, কাছের জনরা তাকে চেনেন আরও ছোট নামে- সুরেন। অনেক ঐতিহাসিক রায় লিখেছেন তিনি। এবার নিজেকে দিয়েই লিখলেন নতুন ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির তালিকায় এবারই প্রথম কোন নাম যুক্ত হলো যিনি অমুসলিম। ইতিহাসের পাতাকে বর্ণিল করেছে তার জাতিগত পরিচয়। তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরও। ইতিহাস গড়ে হয়ে উঠেছেন পুরো মণিপুরি জাতির অহংকারের প্রতীক। এমন স্বপ্নের বীজ কিন্তু অনেক আগে থেকেই বোনা ছিল এস কে সিনহার মনে। যখন তিনি কর্মজীবনের প্রবেশের দ্বারে তখন থেকেই তার মনে এমন স্বপ্নের আনাগোনা। বাবা ললিত মোহন সিনহা চেয়েছিলেন সরকারি কোন চাকরি নিয়ে নিশ্চিত জীবনে থিতু হন ছেলে। তবে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহী ছিলেন না এস কে সিনহা। সুযোগ এসেছিল তবে চোখ ফেরাননি সেদিকে। হৃদয়জুড়ে ছিল আইনের ঘর-বারান্দা। শপথ ছিল মনে এ ভুবনের শীর্ষে পৌঁছুবেন একদিন।
স্বপ্নের মতো সাজানো এস কে সিনহার ব্যক্তি জীবনও। ১৯৭৮ সালের ২রা জুলাই কমলগঞ্জের মাধবপুর ইউনিয়নের জবলার পার গ্রামের সমরেন্দ্র কুমার সিনহা ও হেমলতা সিনহার বড় মেয়ে সুষমা সিনহার সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন এস কে সিনহা। সুখী সংসারে তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সূচনা সিনহা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, স্বামী বিদ্যুৎ প্রকৌশলী। ছোট মেয়ে আশা সিনহা স্বামীর সঙ্গে কানাডায়।
ব্যস্ত জীবনে খুব কমই অবসর মেলে এস কে সিনহার। সেটারও মাপা মাপা ব্যয় করেন তিনি। অবসর পেলে গান শুনেন বাংলাদেশের নতুন প্রধান বিচারপতি। রবীন্দ্র সংগীতই তার পছন্দের তালিকায়। খাবারে তেমন বাছবিচার না থাকলেও দুর্বলতা রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ভর্তার প্রতি। কোষ্ঠী বিচারে তিনি তুলা রাশির জাতক। পোশাক হিসেবে প্রথম পছন্দ পাঞ্জাবি-পায়জামা। কাছে টানে হালকা ধরণের রঙগুলো। কথা হয় এস কে সিনহার বাল্যবন্ধু কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক রফিকুর রহমানের। বন্ধুকে নিয়ে বেশ গর্বই তার। বললেন, এতো উঁচু মাপের মানুষ তবে এতটুকু বদলে যাননি তিনি। শত ব্যস্ততার মাঝেও ও আমার সঙ্গে প্রায়ই ফোনে আলাপ হতো। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও আমি ঢাকায় তার বাসভবনে গিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছি। অধ্যাপক রফিক বলেন, বর্তমান মহাজোট সরকার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত আদিবাসী সম্প্রদায়ের একজন যোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এস কে সিনহাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিযুক্ত করায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে কমলগঞ্জ উপজেলার সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, বলেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত হয়েছি।
নিজেকে গর্বিত দাবি করে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, কমলগঞ্জের সন্তান এস কে সিনহা স্যার প্রধান বিচারপতি হয়েছেন এবং তাঁর এলাকায় কর্মরত থাকতে পেরে গোটা উপজেলাবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় গৌরবের বিষয়।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।