- হোম
- >
- শিল্প-সাহিত্য
- >
- বাঙলার অনন্য চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ
বাঙলার অনন্য চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ
দিনটি ছিলো ৭ই মার্চ, ১৯৭১ সাল। তৎকালীন ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিকামী লাখো জনতার সম্মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান শোনালের বাঙালি জাতীয় জীবনের সেই অনন্য কবিতা;
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
জয় বাঙলা
মুহূর্তেই উপস্থিত লক্ষ জনতা বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গর্জে উঠলেন, বাংলার আকাশ বাতাস তখন একটি স্লোগানেই প্রকম্প্রিত, “জয বাঙলা”। স্বাধীনতার এই আহবান শুধু উপস্থিত জনতাকে নয়, বরং এই আহ্বানের কবিতা জাগ্রত করেছিল ৭ কোটি বাঙালীর মুক্তির আকাঙ্খাকে। বঙ্গবন্ধুর এই কবিতা যাদের ঘরছাড়া করে স্বাধীনতার যুদ্ধে টেনে এনেছিলো শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাদেরই একজন। বিশ্বব্যাপী যার পরিচয় আন্তজার্তিক খ্যাতি সম্পন্ন একজন বাঙালী চিত্রশিল্পী হিসেবে। আজ আমরা চেষ্টা করবো ক্ষুদ্র পরিসরে দিগন্ত খ্যাতি সম্পন্ন এই গুণী শিল্পীর জীবনের নানা দিক তুলে ধরতে।
জন্ম ও পরিবার
চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ১৯৫০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার আলগী গ্রামে। পিতা তায়েবউদ্দীন প্রধান ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, মাতা সাইফুন্নেসা আহমেদ ছিলেন গৃহীনি। তায়েবউদ্দীন এবং সাইফুন্নেসার সংসারে শাহাবুদ্দিন ছিলেন জ্যেষ্ঠ সন্তান। স্ত্রী আনাÑ ইসলাম, কথা সাহিত্য ও শিল্প সমালোচক। শাহাবুদ্দিন-আনার সংসার জীবনে আছে দুই মেয়ে চিত্র ও চর্যা। তারাও শিল্প চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
শিল্পী শাহাবুদ্দিন ১৯৬৮ সালে এস.এস.সি পাশ করেন ফরিদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আটর্স বিভাগ থেকে অর্জন করেন বিএফএ ডিগ্রী। ঐ সময়ে তিনি ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চারুকলায় ফ্রান্স সরকারের দেয়া বৃত্তিলাভ করে ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ইকোল দে বোজার্ট চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। শিল্পী শাহাবুদ্দিন অদ্যাবধি প্যারিসে কর্মরত আছেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন তিনি। সহযোদ্ধা হিসেবে তাঁর সাথে ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা এবং পপ স¤্রাট আজম খান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড গতি, শক্তি, সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণের সাহসের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। তাই শিল্পী তার চিত্রকর্মে গতিকে প্রাধান্য দেন বেশি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি রয়েছে শিল্পীর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা, যা তাঁর অনন্য কিছু চিত্রকর্মে উঠে এসেছে।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাঁর চিত্রকলায় সংগ্রামী মানুষের প্রতিকৃতিতে দুর্দমনীয় শক্তি ও অপ্রতিরোধ্য গতির ইংগিতময় অভিব্যাক্তির জন্য সুপরিচিত। তিনি মনে করেন, মানুষের মুক্তিযুদ্ধ অদ্যাবধি চলমান, এবং রং ও তুলির দ্বৈত অস্ত্র সহযোগে তিনি এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে চলেছেন। সত্তরের দশকের প্রারম্ভে বাংলাদেশে বিমূর্ত চিত্রকলার যে দুবোর্ধ্য পর্বের সূচনা হয়েছিল, তার সঙ্গে গাঁটছড়া না বেঁধে তিনি নির্মাণ করেন স্বকীয় শৈলী, যার ভিত্তিতে রযেছে শারীরিক প্রকাশভঙ্গী। তাঁর এই চিত্রশৈলী বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
চিত্রকলায় অবদান
বড ক্যানভাসের পর্দায় গতিশীল ও পেশীবহুল অতিমানবীয় পুরুষের ছবি আঁকতে ভীষণ পছন্দ করেন শাহাবুদ্দিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে উপজীব্য করে রং-তুলির সাহায্যে যথাযথ উপস্থাপনা, প্রতিস্থাপন ইত্যাদি বিষয়গুলো সার্থক ও সফলভাবেই সম্পন্ন করেছেন তিনি। এছাড়াও, শাহাবুদ্দিনের তুলিতে নারী চিত্রকর্মগুলোয় তাদের চিরায়ত কোমলতা, দ্যুতির স্পন্দন, স্নিগ্ধতা দেখা যায়। মিহি কাপড়ের মাধ্যমে নারীকে আবৃত করে শারীরিক সৌন্দর্য্যরে দ্যুতি তুলে ধরেন তিনি যাতে রমণীর অলৌকিক ও অসীম শক্তি বিচ্ছুরিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাÑ এই দুই অনুষঙ্গই তাঁর চিত্রকর্মের প্রধান উপাদান। এর সঙ্গে ইউরোপীয় চিত্রকলার ঐতিহ্যের মিশ্রন তাঁর চিত্রকর্মকে করে তুলেছে ভিন্নধর্মী। শিল্পের মিথস্ক্রিয়ার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গতিশীলতা, সাহস ও শক্তিমত্তা মিলিয়ে অতিমানবীয় অনুরণন তাঁর ক্যানভাস জুড়ে।
চিত্র প্রদর্শনী
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের সময় জঙ্গলের ভিতরে শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। জঙ্গলে কিংবা আগরতলায় কাগজ না পাওয়ায় ক্যালেন্ডারের পিছনের সাদা পাতায় কাজল, কয়লা, সবজির আঠা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পোর্টেট আঁকেন শিল্পী। ত্রিপুরা সরকারের সহযোগীতায় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহনে একটি বড় ধরণের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় জঙ্গলের মধ্যেই। হারমোনিয়ামের বাজনা, সাথে ছিল পপ সম্রাট আজম খানের গান। সবার জন্যে খিচুড়িরও ব্যবস্থা করেছিলো ভারতীয় সরকার। গান-বাজনা আর খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন টর্চলাইটের আলো গিয়ে পড়লো বঙ্গবন্ধুর ছবির উপর ‘জয় বাঙলা’ স্লোগানে পুরো জঙ্গল কেঁপে উঠলো। সবাই দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলো।
এছাড়া দেশ-বিদেশের নানা গ্যালারীতে একক ও যৌথভাবে শিল্পীর চিত্রকর্মের বহু প্রদর্শনী হয়। তন্মধ্যে একক প্রদর্শনী হিসেবে-
১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্তদেরকে অর্থ সাহায্যের জন্য ঢাকায় চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে চিত্র প্রদর্শনী;
হল্যান্ড, পোল্যান্ড, সেনেগাল, বেলজিয়াম এবং ভারত-সহ সুইজারল্যান্ডের লুসানে অবস্থিত অলিম্পিক মিউজিয়াম এবং ফ্রান্সের বোর্গ-এন ব্রেজ মিউজিয়ামেও বৈশ্বিকভাবে প্রদর্শন অন্যতম।
যৌথ প্রদর্শনী হিসেবে-
সেঁজুতির প্রথম চিত্রকলা প্রদর্শনী ও ভাষা আন্দোলন উপলক্ষ্যে চিত্র প্রদর্শনী, ঢাকা, বাংলাদেশ;
প্যারিসে অধ্যয়নরত শিল্পীদের আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী, প্যারিস, ফ্রান্স;
প্যারিসে ইউনেস্কো আয়োজিত আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী, প্যারিস, ফ্রান্স;
বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পকলা প্রদর্শনী, চীন;
গ্যালারী কনট্রাস্টে চিত্র প্রদর্শনী ব্রাসেলস, বেলজিয়াম;
"দি হারমোনী শো", মুম্বাই, ভারত;
ইতালি ও কিউবাতে চিত্র প্রদর্শনী;
"সিগার দ্য লা হাভানা আ হরিজন ২০০০" চিত্র প্রদর্শনী, প্যারিস, ফ্রান্স।
শাহাবুদ্দিন আহমেদের বিভিন্ন চিত্রকর্ম বাংলাদেশ-সহ বুলগেরিয়া, তাইওয়ান, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্সের বিভিন্ন প্রখ্যাত গ্যালারী, বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত আছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
চারু ও কারুকলায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশ-বিদেশে অনেক পুরস্কার পান শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ।
(১) রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক ১৯৬৮ শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী(২) প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক ১৯৭৩(৩) বাংলা একাডেমীর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৭৪(৪) ১ম পুরস্কার ১৯৭৫ প্যারিসে অধ্যয়নরত শিল্পীদের আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী(৫) ১ম পুরস্কার ১৯৭৯ প্যারিসে আয়োজিত ৩১টি দেশের শিল্পীদের আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী(৬) ১ম পুরস্কার ১৯৮০ ইউনেস্কো আয়োজিত আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী(৭) শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ১৯৮২ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনী(৮) স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ২০০০ চারুকলা ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ
শাহাবুদ্দিন আহমদ সব সময় উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরেন। লাল, কমলা, নীল ও সবুজের মতো উজ্জ্বল রং তাঁর মনকে আনন্দময় করে তোলে। সাধারণত একরঙা শার্ট বেশি পরেন তিনি। মাঝেমধ্যে চেকের ফ্যাশনেবল প্যান্ট পরেন। তবে চাপা কাটের প্যান্ট তাঁর বেশি প্রিয়। শার্ট-প্যান্ট ও বেল্ট তিনটি উজ্জ্বল রঙের হলেও কনট্রাস্ট করে পরেন। ছবি আঁকা কিংবা সাধারণ সময়ে ভি-গলার টি-শার্ট পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কোনো ব্র্যান্ডের প্রতি বিশেষ ঝোঁক নেই। ফরমাল অনুষ্ঠানে শার্ট ও প্যান্টই পরেন। প্যারিসে শীতের সময় সোয়েটার ও ওভারকোট পরেন। এই দীর্ঘ জীবনে মাত্র দুবার ব্লেজার পরেছেন তিনি, তবে কখনোই টাই পরেন নি। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবি পরেন। ভালোবাসেন রাঁধতে, বাগান করতে খুব পছন্দ করেন। নিয়মিত না হলেও সময় পেলে সিনেমা দেখেন।
বিশ্ব শিল্পকলায় একদিন নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ, বাঙলার তরুণ শিল্পীরাই একদিন জয় করবে বিশ্ব কে। এই স্বপ্নই বুকে লালন করেন বাঙলার এই বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।