- হোম
- >
- শিল্প-সাহিত্য
- >
- আমার দেখা মুজিব
আমার দেখা মুজিব
শেখ মুজিবুর রহমান যখন “বঙ্গবন্ধু” হয়নি, বলা যেতে পারে তার কিশোর বয়স থেকে আমি তাকে জানি । সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাকে প্রথম দেখি কলকাতায় । তখন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সে। রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দীর খ্যাতি তখন তুঙ্গে, সেই সময় থেকে ছাত্রকর্মী- ছাত্রনেতা হিসেবে মুজিবর রহমানকে আমি চিনি আজীবন। নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছেন মুজিবর রহমান। কিন্তু আমার কাছে আমার ছোট ভাইয়ের মতই ছিল সে। বরাবর আমাকে “আপা” বলে সম্বোধন করেছেন। কাছে গেছি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি, তারপর একই পাড়ায় থাকার কারনে মুজিবের সঙ্গে আমার একটা পারিবারিক সম্বন্ধের মতন গড়ে উঠেছিল।
মুজিবের কথা বলতে গেলে মুজিবের স্ত্রীর কথাও বলতে হয়। এত ধৈর্যশীলা, এত শান্ত, এত নিষ্ঠাবতী মহিলা খুব কমই দেখা যায়। বছরের বারো মাসের মধ্যে বেশির ভাগ সময় মুজিবের কেটেছে জেলে। যখনি শুনেছি মুজিবকে ধরে নিয়ে গেছে, ছুটে গিয়েছি। দেখেছি মুজিবের স্ত্রী অবিচল মুখে কাপড়-বিছানা বালিশ গুছিয়ে পাঠানোর বেবস্থা নিছে। বলেছে আপনার ভাই তো জেলে গেছে। বেচারী খুব ধৈর্যের সাথে সংসারটাকে টেনেছে। বাপকে জেলে নিয়ে গেছে বলে কোন স্কুলে হাসিনাকে ভর্তি করবে না- এমনও দিন গেছে। নারী শিক্ষা মন্দিরে আমরা তাকে ভর্তি করে নিলাম। তখন নারী শিক্ষা মন্দিরের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম।
একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে পায়ে হেঁটে হেঁটে মুজিবের সাথে গিয়েছি শহীদ মিনারে ফুল দিতে। মুজিব বলেছে, আহা আমার বোনটা, আমার আপাটা এইভাবে হেঁটে যাবে? আপা, আপনি হেঁটে যাবেন না। আপনি রিকশায় যান। আমরা হেঁটে যাই। আমি বলেছি, না ভাই, আমি হেঁটেই যেতে পারব। এভাবে মুজিবের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে মিটিং-এ যোগ দিয়েছি। আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। মুজিব সবসময় আমাকে বড় বোনের মতন সাথে রেখেছে। রাস্তায় দেখা হলে গাড়ি থামিয়ে বলেছে, আপা, শিকগির আসেন গাড়িতে আসেন। আমি বলেছি, না ভাই, এইটুকুন পথ তো- এইখান থেকে এখানে, হেঁটে যেতে পারব। কিন্তু মুজিব বলেছে, না আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। ড্রাইভারকে বলেছে, আমার বোনকে আমার বোনের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসো।
মুজিবের বাড়িতে গেইয়েছি । শত মিটিং হলেও মুজিব এসে আমাকে বলেছে, আপনি এসে আমাকে খবর দেন কেন ? আপনি সরাসরি আমার কাছে চলে আসবেন। আপনি এসে কেন নিচে বসে থাকেন? আমার বাড়ি আপনার বাড়ি। আমি আপনাকে বড় বোনের মত মনে করি। মুজিব প্রতিদিন ভোরবেলা তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে পায়ে হেঁটে এক চক্কর দিত। একদিন আমাকে দেখতে পেয়ে হাসতে হাসতে বলল, গত কাল মনে হল যে আপনার বাড়িতে তো পিঠা হছে। আপনাকে একটা ডাক দেব নাকি ? কিন্ত এত ভোরে আপাকে আর ডাক দিলাম না। এই পর্যন্ত তার একটা আন্তরিকতা ছিল আমাকে নিয়ে পিঠা খাওয়াবে। আমার মেয়ের স্বামী আব্দুল কাহহার চৌধুরী চাটগাঁ রেডিওর অফিসার ছিল। একাত্তর সালে পাক বাহিনীর হাতে মারা যায়। দেশে ফেরার পর মুজিব এ ঘটনা শুনল। বলল, কই, দুলু কোথায়? আমার মেয়ে বিধবা হলে যেমন কষ্ট পেতাম সেরকম কষ্ট বোধ করছি। দুলু যা চায়, আমি ওকে সব দেব। আমি বললাম, এরকম মানুষ এরকম গেছে। আমার জামাই ও গেছে। তার জন্য শুধু দুয়া করো। মুজিব আমার বলল, আপা, আমি আপনার কাছে হাত জোর করে বলছি, আপনি বলেন আমি দুলুকে কি সাহায্য করতে পারি ? আমি বললাম, ভাই, রক্তের বিনিময়ে আমার মেয়েকে কিছু দিতে হবে না। দেশের হাজার মেয়ের মত আমার দুলুও বিধবা হয়েছে। অনেক বিধবা তো আমার আশ্রয়েই রয়েছে। ওদের জন্যেও শুধু দুয়া করো। তারপর সে যখন রাষ্ট্রপতি হল, আমাকে বলেছে একবার এসে আমাকে দোয়া করে যান। গাড়ি পাঠাল। আমি গেলাম। ওই প্রথম যাওয়া। ওই শেষ যাওয়া আমার প্রেসিডেন্ট হাউসে। তখন বাকশাল গঠিত হয়েছে। মুজিব বলল, একটা লোক পাঠাছি না যাকে আমি বাকশালের ভার দেব। আপা, আপনি রাজি হন তবে বাকশালের সভানেত্রী হয়ে থাকুন। আপনি যেরকম বলবেন, সেই রকমই হবে। আমি বললাম, ভাই, আমি রাজনীতি বুঝি না। আমাকে মাফ করো। এই আমি সেই বাকশালে গেলাম না। কিন্তু যখনি কোন মিটিং হয়েছে আমি মুজিবের সাথে গিয়েছি। তারপরে বলেছে, আওয়ামী লীগের মহিলা কমিটি গঠন করে সেখানে আপনি সভানেত্রী হয়ে থাকুন। সবসময় সে আমাকে সম্মানের পদ দিতে চেয়েছে। আমি বলেছি, ভাই, রাজনীতির মধ্যে আমি পারব না। রাস্তায় নামতে পারি, কিন্তু রাজনীতির কোন সংশ্রবে আমি থাকব না। তখন মুজিব বলেছে, আপা, আপনাকে আমি মাথায় রাখব, না আপনাকে আমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করব ? আমি আপনার কাছে মিনতি করছি। আমিও বলেছি, ভাই, আমিও মিনতি করছি।
ধানমণ্ডি পাড়ায় মুজিবের আগে আমি আসি। তাকে গ্রেফতারের সময় গুলোতে তার ছেলেমেয়েদের স্কুলের ভর্তির সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার বউ একটা বাড়ি খুজে পাছে না। এই দুর্দশার মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান নেতা হয়েছে। মুজিবের ত্যাগের কোন সীমা নেই। তার নিষ্ঠার কোন পরিসীমা নেই। দেশকে যে সে কতখানি ভালবাসত তার পরিমাণ কোথাও নেই। মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ, আত্মার একটা টান তার ছিল। আজকের দিনে তার মত একটি মানুষ সারা দুনিয়ায় আমি দেখতে পাছি না। তার পলায়নি মনোবৃত্তি ছিল না। যেখানে সংকট, সেখানে সংগ্রাম, যেখানে সংঘাত দেখেছে, সে এসে আগে দারিছে। মরণকে ভয় করেনি। তার পেছনে লক্ষ জনতা “মুজিব ভাই” বলে লাফিয়ে পড়ে এই দেশকে স্বাধীন করেছে। “ বাঙ্গালি আমাকে মারবে না” – মুজিবের এই বিশ্বাস ছিল বাঙ্গালির ওপর। সেই বাঙ্গালির হাতে মুজিব হত্যা হয়েছে। এই বাঙ্গালি জাতির সেই পাপের, সেই গুনাহর প্রায়শ্চিত্ত কবে হবে, আমি জানি না। মুজিবকে আমি সারা অন্তর দিয়ে এখনও উপলব্ধি করি। সে যা দিয়ে গেছে—সোনার বাংলা, সেই সোনার বাংলায় যারা আগুন লাগাছে, তাদের ধিক্কার দেয়ার কোন ভাষা আমার নেই। মুজিবের দেশপ্রেম আদর্শ নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপ্ত হোক- এই প্রার্থনা করি।
দুই
বমা, বন্দুক, গগন ভেদী বিস্ফোরণের শব্দ অতিক্রম করে ৭ই মার্চ উন্মুক্ত মাঠে জলদ- গম্ভীর একটি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলঃ “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”। সেই কণ্ঠ অনুসরণ করে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের জয় যাত্রা।
মহান নেতা, দেশপ্রেমিক বলিষ্ঠ সাহসী নেতা বঙ্গবন্ধুর সেই স্বরে ছিল মুক্তির আহ্বান। দেশের মুক্তি, মানবতার মুক্তি, আত্মশক্তির মুক্তি। তাই নিরস্ত্র বিপন্ন বাঙ্গালিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, অসম সাহসে তারা অসুর শক্তিকে বিনাশ করে দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছিল।
মা দিয়েছে তার বত্রিশ নাড়ি-ছেঁড়া ধন সন্তানকে, বধু দিয়েছে স্বামীকে, বোন দিয়েছে ভাইকে, অসহায়ের আর্তনাদ উপেক্ষা করে পাকিস্তানি বর্বরেরা চালিয়েছে তাদের নির্মম অত্যাচার, কিন্তু ধমন করতে পারেনি বাঙ্গালির শৌয কে। আল্লাহ্র নামে শেখ মুজিবের আদর্শে উদবুদ্দ হয়ে এগিয়ে চলেছে। বিশ্ব বিবেক বিস্ময়ে অবলোকন করেছে এই মহান আত্ম ত্যাগ। তাই এগিয়ে এসেছে ভারতের মহীয়সী নারী ইন্দিরা গান্ধি, এগিয়ে এসেছে মানব ধর্মী রাশিয়া। বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের মুক্তিবাণী তাই বিশ্বের বিস্ময় হয়ে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।