লাউয়াছড়া উদ্যানের টিলায় টিলায় চলছে বৃক্ষ নিধনের মহোৎসব
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের টিলায় টিলায় চলছে বৃক্ষ নিধন। বাংলাদেশের অন্যতম সংরক্ষিত এ বনাঞ্চল স্থানীয় কিছু লোভী মানুষের কাছে যেন সোনার খনি। গাছ কাটলেই পকেট ভরে ওঠে কাঁচা টাকায়। তাই তারা মেতে ওঠেন গাছ কাটার মহোৎসবে। রক্ষকরা দেখেও না দেখার ভান করেন নয়তো নিজেই শামিল হন এ উৎসবে। বেপরোয়া গাছ কাটার ফলে অনেকটাই হুমকির মুখে ৯০ বছরে গড়ে ওঠা লাউয়াছড়া। প্রায়ই লাউয়াছড়ার বয়সী বৃক্ষের গায়ে করাতের আঁচড় পড়ে। বাইরে থেকে দেখে বোঝা না গেলেও ভেতরে ঢুকলেই এ অরণ্যের গায়ে ক্ষত চিহুগুলো চোখে পড়ে।
সবুজের সমারোহ আর বিচিত্র প্রাণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মৌলভীবাজার রেঞ্জের আওতাধীন কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া বন বিটকে ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। তবে বন হিসেবে লাউয়াছড়ার যাত্রা শুরু বিশ শতকের প্রথম ভাগে। ১৯২৫ সালে কমলগঞ্জের ভানুগাছে তৎকালীন বৃটিশ সরকার এ বনায়নের সূচনা করে। তবে অরণ্যের প্রাণ বৃক্ষরাজি বিপন্ন হয়ে পড়ায় হুমকির মুখে পড়েছে পুরো লাউয়াছড়াই। জাতীয় ই-তথ্যকোষের হিসাবে লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে।
এর মধ্যে আগর, সেগুন, চাপালিশ, জারুল, আকাশমণি, আওয়াল, লোহাকাঠ সহ ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভয়চর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। তবে সরজমিন দেখে এলে যে কারও মনে হবে হিসাবটা নতুন করে মেলাতে হবে। বনের পথে অনেক দূর পাড়ি দিয়েও এর বাসিন্দাদের সাক্ষাৎ মেলে না।
অরণ্যে ঢুকলেই দর্শনার্থীদের যে স্বাগত জানাতো লাউয়াছড়ার অন্যতম আকর্ষণ সে উল্লুকের দেখাও এখন আর সহজে মেলে না। গাছও যে কমছে তার প্রমাণ অরণ্যজুড়ে সারি সারি পড়ে থাকা কাটা গাছের গুঁড়ি। নভেম্বরের প্রথম ভাগেই উদ্যানের মাগুরছড়ার পশ্চিম এলাকা, তেরঘরি, ফুট ট্রেইল, ডরমিটরি এলাকা, জারুলি লুংড়া, রিং-ভাঙা, বড়খলা, নার্সারি, অক্সিডেন্টাল এলাকা, জানকিছড়া, ফাটাবট, জোড়া সাইন বোর্ড, তলউনী, গোলটিলা, ছনখলা, বাঘমারা, টিকিট কাউন্টারের সামনের ১ নম্বর নামে পরিচিত এলাকা, গাড়ি ভাঙা ও এর আশপাশ এলাকা থেকে সেগুন, আগর, চাপালিশ, আওয়ালসহ বিভিন্ন প্রজাতির শতাধিক গাছ কেটে পাচার করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ক্ষমতার পালা বদলে যে ভাবে নেতারা দল বদল করেন লাউয়াছড়া বনের গাছ পাচারেও সে রকম দল বদল হয়ে থাকে। বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই লাউয়াছড়া থেকে কেটে নেওয়া হয় বনের বাছাই করা গাছগুলো। স্থানীয়রা বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের যোগসাজশেই পাচার হচ্ছে শ’ শ’ কোটি টাকার গাছ। এমন অভিযোগে বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট বিট ও রেঞ্জ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও নিধনযজ্ঞ থেমে থাকেনি। অল্প সময় বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয় গাছ পাচারের প্রতিযোগিতা। কাঠ পাচারের মাধ্যমে নিরাপদে অধিকতর ‘মুনাফা’ থাকায় লাউয়াছড়া বন বিটে পোস্টিংয়ের জন্য প্রতিযোগিতাও জমে ওঠে।
বনের পরিবেশ রক্ষায় বন বিভাগের পাশাপাশি কাজ করছে ক্রেল নামের একটি সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে তারা বনের সুরক্ষার বিষয়টি দেখভাল করছে। বনরক্ষায় তারা স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে দিয়েছে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি)। সিএমসি’র তত্ত্বাবধানে কমিউনিটি প্যাট্রলিং গ্রুপ (সিপিজি) নামে একটি টহল দল বাগান প্রহরার কাজ করছে। অভিযোগ, এদের অনেকেই এলাকার চিহ্নিত গাছচোর ও পাচারকারী দলের সদস্য। লাউয়াছড়া বন বিট কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন বলেন গাছচোরদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ায় হয়েছে।
তিনি জানান, বনজুড়ে সরকারি পাহারাদার রয়েছে ৩ জন আর দু’টি ক্যাম্পে আছে আরও ৩ জন। এর বাইরে ২৪-২৫ জন পাহারার দায়িত্বে রয়েছে।
তিনি জানান, গাছ চোরদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হচ্ছে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।