- হোম
- >
- কৃষিজ ও প্রাণিজ
- >
- রামগতিতে পেশা ছাড়ছে গাছিরা, বিলুপ্তির পথে খেজুর রস
রামগতিতে পেশা ছাড়ছে গাছিরা, বিলুপ্তির পথে খেজুর রস
সময় বদলে যাওয়ার সাথে সাথে বদলাচ্ছে মানুষের সাধারণ জীবন-যাপনের গঠন প্রণালী। তারই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রচলিত সংস্কৃতি। অপসংস্কৃতির কাছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এখন জিম্মি। গ্রামে একটি প্রবাদ আছে ‘আমরা মাছে-ভাতে বাঙালী’। এক সময় এটাই বাঙালী জাতির বড় পরিচয় বলে আমাদেরকে মনে করিয়ে দিতো।
সে সময়ে ছিলো বাংলার নানা ঐতিহ্য, যেগুলো আমাদের গ্রামবাংলাকে করেছিলো সমৃদ্ধ। কালের বিবর্তনের সাথে সাথে এখন গ্রামবাংলার বহু ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। এক সময় গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর গোলা ভরা ধান ছিল। এসব কিছু হারিয়ে আজ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে।
এমনই এক ঐতিহ্যবাহী পণ্য ছিলো খেজুর গাছের রস ও খেজুরের মিঠাই (গুড়)। লক্ষ্মীপুর জেলায় এমন কোনো বাড়ি বা রাস্তা ছিলো না যেখানে অন্ততঃ দু’-একটি খেজুর গাছ ছিলো না। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী কার্তিক মাস থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতি বাড়ির দু’-একজন মধ্য বয়সী বাপ-চাচা খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন,। যারা খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করতো। স্থানীয়ভাবে গ্রাম্যভাষায় তাদেরকে ‘গাছি’ বলা হত।
গাছিরা দিনের বেলার মধ্যভাগ থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত ধারালো একটি চেনি (দা) মুগুর আর রস সংগ্রহের হাঁড়ি নিজের পিঠের পিছনে একটি লম্বা ঝুড়িতে বেঁধে এ বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি বয়ে নিয়ে যেতো খেজুর গাছ কাটার জন্য। এ কাজে গাছিদেরকে বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়েরা সাহায্য করতো পিছনে পিছনে হাড়ি বহন করে। আবার খুব ভোর থেকে গাছিরা বিভিন্ন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে খেজুরের গুড় তৈরির জন্য একত্রিত করতো। সকাল থেকে দিনের অর্ধবেলা পর্যন্ত মা-বোনেরা বড় কড়াইতে করে রস থেকে গুড় বা মিঠাই তৈরী করতো।
অন্যদিকে অনেক গাছি কুয়াশার ভিতরে গ্রামের মেঠো পথ ধরে কাঁধে রসের ভার বহন করে হেঁটে চলতো রস বিক্রির আশায়। দিনের বেলায় পাখিরা রসের চুঙ্গিতে(বাঁশের তৈরি উপকরন) বসে মনের সুখে রস খেয়ে উড়ে চলে যেতো। মৌমাছিরাও রসের আশায় ভোঁ ভোঁ করে উড়ে চলে আসত। সে দৃশ্য দেখে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যেতো সবার।
গ্রাম-বাংলার শীতকালীন অন্যতম খাবার হিসেবে প্রতি বাড়িতে সকাল বেলা খেজুর রসের ফিন্নি-পায়েস তৈরী হতো। পরিবারের সবাই খুব মজা করে সেই ফিন্নি-পায়েস খেতো। পৌষ মাসে যখন তীব্র শীত পড়তো তখন গ্রামের অনেক তরুন বয়সী দুষ্ট ছেলেরা রাতের বেলায় পাড়ার বিভিন্ন খেজুর গাছ থেকে রস নিয়ে রাতেই পায়েস রান্না করে আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে খেত। ফিন্নি তৈরির আনন্দ-উৎসব এখন আর চোখে পড়ে না।
গ্রামের সব মানুষের কাছেই খেজুর গুড়ের কদর ছিলো ব্যাপক। মুড়ি থেকে মোয়া তৈরীর প্রধান উপকরণ ছিলো এই খেজুরের গুড়। গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে খেজুরের গুড় পাওয়া যেতো কিন্তু সময়ের টানে আজ বাঙালীর সেই ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ পর্যাপ্ত নেই, নেই খেজুরের সেই রস সেইসাথে খেজুরের মিঠাই নামের গুড়ও আগের মত পাওয়া যায় না।
বাংলার ঐতিহ্যের সূচী থেকে এভাবে লোভনীয় বস্তুটি এত দ্রুত হারিয়ে যাবে কেউই তা মানতে নারাজ। লক্ষ্মীপুর জেলা একসময় এ ঐতিহ্যবাহী খেজুর রসের জন্য বিখ্যাত হলেও এখন তা আর নেই। কার্তিক শেষে অগ্রহায়ণ চলতে লাগলো কিন্তু কোথাও কোনো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের অয়োজন চোখে পড়ে না। রাস্তার পাশে কিংবা বাড়ির আড়ায় কেউ খেজুর গাছ রোপন করছে না। এটি এখন দুর্লভ বস্তু হিসেবে পরিণত হয়েছে। জেলার সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতিসহ সকল উপজেলার তথ্যচিত্র প্রায় একই রকম।
এ সম্পর্কে রামগতি উপজেলার চরলক্ষ্মী গ্রামের এক সময়কার নামকরা গাছি আবদুল হক (৬৫) বলেন, ‘এখন শীতের সময় খেজুর রস নেই এটা বিশ্বাস করতে পারছি না’ জীবনে খেজুর গাছ কাটার পিছনে অনেক সময় ব্যয় করেছি। আমাদের দুর্ভাগ্য হল মেঘনার করাল গ্রাসে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ফলে অনেক খেজুর গাছ আমরা হারিয়েছি। এখন রামগতি বাজারও ভেঙে যাওয়ার পথে।
বাংলার ঐতিহ্য বিশ্বাস করেন এমন সচেতন মহল জানান, আমাদেরকে বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে এবং এটা আমাদের সবার স্বার্থেই।
রামগতি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুছ ছোবাহানের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, খেজুর গাছ এখন আর দেখা যায় না তাই, খেজুর গাছ আগামী প্রজম্মকে দেখাতে হলে সবার আগে খেজুর গাছ সংরক্ষণ করতে হবে। এখন গ্রামে কেউ আর খেজুর গাছ রোপন করতে চায় না। এজন্যই ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস কিংবা খেজুর গুড় পেতে হলে প্রতি বছর বৃক্ষরোপনের সময় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে খেজুর গাছ রোপনের উপর জোর দিতে হবে। নতুবা চিরতরে হারিয়ে যাবে আমাদের বাঙালীর ঐতিহ্য খেজুরের রস।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।