ইউনূসের মওকুফকৃত ঋণ ফেরত নেবে সরকার
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান প্যাকেজেস কর্পোরেশনকে ১৯ বছর আগে মওকুফ করা ঋণের অর্থ ফেরত নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও গ্রামীণ ব্যাংকের মধ্যে দফায় দফায় চিঠি চালাচালির পর ২০০৫ সালে মওকুফ করা সুদাসল এক কোটি ৩৭ লাখ টাকার মধ্যে আসল ৮৯ লাখ টাকা ফেরত নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে উল্লেখ করে ওই অর্থ ফেরত না নেওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক। যদিও ওই অর্থের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রাহকদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা নেই।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্যাকেজেস কর্পোরেশনকে মওকুফ করা ঋণের অর্থ থেকে আসল ৮৯ লাখ টাকা ফেরত নেওয়ার পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত পাওয়া গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে বলেছে, গ্রামীণ ব্যাংক যাতে ওই অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়, সে নির্দেশনা দিতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামতের ভিত্তিতে প্যাকেজেস কর্পোরেশনের কাছ থেকে ৮৯ লাখ টাকা ফেরত আনতে শিগগিরই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে চিঠি পাঠানো হবে।
মন্ত্রীপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১ জুলাই এ বিষয়টিসহ মোট পাঁচটি বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মতামত প্রতিবেদন আকারে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে গত ২০ অক্টোবর। প্রতিবেদন প্রস্তুতের আগে গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে মতামতও নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
১৯৯০ সালের পর থেকে প্যাকেজেস কর্পোরেশনকে মূলধন ও চলতি ঋণ দিয়ে আসছিল গ্রামীণ ব্যাংক। তবে ২০০৫ সালের দিকে এসে ওই ঋণের সুদ ১৬ শতাংশ ও ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এতে প্যাকেজেস কর্পোরেশনের কাছে পাওনা এক কোটি ৪৪ লাখ টাকার মধ্যে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকাই মওকুফ হয়ে যায়। মওকুফ করা ওই অর্থের মধ্যে ৮৯ লাখ টাকা ঋণের আসল থেকে মাফ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো তফসিলি ব্যাংক তার বিতরণ করা ঋণের আসল মওকুফ করতে পারে না, শুধু সুদ মওকুফ করতে পারে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক অ-তফসিলি ব্যাংক হওয়ায় প্যাকেজেস কর্পোরেশনকে মওকুফ করা আসল অর্থ আদায়ের বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের মতামত জানতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে যে মতামত প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, আমানতদারীদের স্বার্থের পরিপন্থী না হলেও দাতাদের অর্থায়নে গঠিত 'সোশ্যাল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড' (এসভিসিএফ) থেকে প্যাকেজেস কর্পোরেশনের অনুকূলে এসআইডিই (স্টাডিস, ইনোভেশন, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টেশন) প্রকল্পের উদ্দেশ্যের বাইরে অবৈধভাবে ঋণ দিয়ে ব্যাংকের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। তাই এই তহবিল এখন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকলে ওই ঋণের মওকুফ করা আসল পরিশোধে গ্রামীণ ব্যাংক প্যাকেজেস কর্পোরেশনকে উদ্যোগী হওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়েও মত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর আগে গত ৪ জুন এ বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংক তাদের মতামত বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায়। এতে বলা হয়, 'গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে বা গ্রাহকদের আমানতের টাকা থেকে প্যাকেজেস কর্পোরেশনকে সরাসরি কোনো অর্থ ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়নি। তবে দাতাদের অর্থায়নে গঠিত এসভিসিএফ তহবিল থেকে দাতাদের সম্মতিতে প্যাকেজেস কর্পোরেশনকে ঋণ দেওয়া হয়। গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালকমণ্ডলীর ৭৬তম সভায় প্যাকেজেস কর্পোরেশনের শুরু থেকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মূলধন ঋণ ও চলতি ঋণের সুদহার ১০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ও ১৬ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশে পুন:নির্ধারণ করে হিসাব নিষ্পত্তি করার অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই সিদ্ধান্তের আলোকে প্যাকেজেস কর্পোরেশনের মূলধন ঋণ ও চলতি ঋণের সুদের হার পরিবর্তিত হারে ধরে প্রতিষ্ঠানটির কাছে সাত লাখ ২২ হাজার ১৬৭ টাকা পাওনা পুন:নির্ধারণ করা হয়, যা ২০০৬ সালের ১৭ এপ্রিল চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করে প্যাকেজেস কর্পোরেশন।'
গ্রামীণ ব্যাংক তাদের মতামতে আরো বলে, 'যেহেতু এটি একটি নিষ্পত্তিকৃত বিষয়, সেহেতু মওকুফ করা অর্থ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া যথাযথ হবে কি না সে ব্যাপারে সংশয় থেকে যায়।' চিঠিতে স্বাক্ষর করেন গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান।
জানা গেছে, গ্রামীণ ব্যাংক ও তার কথিত সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে গত বছর মন্ত্রীসভা বৈঠকে পাঁচটি অভিযোগ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে বিনা অনুমতিতে ড. ইউনূসের বিদেশ সফর ও পুরস্কার-সম্মানী-রয়্যালটি গ্রহণ এবং নির্ধারিত বয়সসীমার অতিরিক্ত সময়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে বেতন-ভাতা বাদে নেওয়া অন্যান্য সুবিধা ফেরত নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
তবে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ও অগ্রগতির তথ্য প্রতিবছর গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পর্যালোচনা করা, পরিচালকদের গ্যারান্টি দ্বারা সীমাবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের শেয়ারের বিপরীতে সমন্বয় করা এবং প্যাকেজেস কর্পোরেশনকে মওকুফ করা ঋণের আসল অর্থ পুনরুদ্ধারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রীসভা। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি যে প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, তাতে প্যাকেজেস কর্পোরেশন ছাড়া বাকি দুটি অভিযোগের বিষয়েও গ্রামীণ ব্যাংককে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে বলে মত দিয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৬১ সালে পাকিস্তান প্যাকেজেস কর্পোরেশন নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির মালিক ছিলেন দুলা মিয়া সওদাগর (ড. ইউনূসের বাবা) ও তাঁর ছেলেরা। ওই পরিবার এখনো প্রতিষ্ঠানটির মালিক। শেয়ারহোল্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে মুহাম্মদ ইউনূস এখনো আছেন। গ্রামীণ ব্যাংক ও প্যাকেজেস কর্পোরেশনের মধ্যে ১৫ বছরের জন্য ব্যবস্থাপনা এজেন্সি চুক্তিটি হয় ১৯৯০ সালের ১৭ জুন। ১৯৯৭ সালে প্যাকেজেস কর্পোরেশনের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ সামগ্রীকে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।