মেঘনার অব্যাহত ভাঙ্গনকবলিত মানুষেরা চায় সমন্বিত পরিকল্পনা
লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর গতিপথ বদলে বাড়ছে ভয়ঙ্কর ভাঙন। নদীর গতিপথ বদলের অন্যতম কারণ হচ্ছে ডুবোচর আর ডুবোচর সৃষ্টি হয় বৈরি প্রকৃতি আর অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের ফলে। ডুবোচর নদীর প্রধান স্রোতধারাকে সরিয়ে নিচ্ছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। প্রবল স্রোতধারা লোকালয়ে আঘাত হেনে হাজারো মানুষ আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে। ফলে ভাঙনরোধে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি তুলেছেন ভাঙনকবলিত মেঘনার তীরে বসবাসরত হাজার হাজার মানুষেরা।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলা তাই এভাবেই প্রতি বছরে ছোট আসছে মেঘনা তীরের এই বিস্তৃর্ণ জনপদ। এ ভাঙন এখন স্থানীয় মানুষের কাছে মূর্তিমান আতংক।
এখানকার মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে ভাঙনের এ চিরায়ত রূপ ও মেঘনার বিক্ষুব্ধতা দেখে এসেছেন, সেই স্থানীয় মানুষদের কাছে ভাঙনের কারণ শুনতে আসেনি কেউ। সমাধানের জন্য তাদের কাছে কেউ পরামর্শও চায়নি। অথচ মেঘনার পাড়ের অবহেলিত মানুষগুলোই ভাঙ্গনের প্রত্যক্ষদর্শী, তারাই বিশেষজ্ঞ। ভাঙনরোধ পরিকল্পনায় এদের মতামত বিশেষ সহায়ক হতে পারে।
সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহকালে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জানতে চেয়েছিল কী কারণে এই ভাঙনের তীব্রতা ? ভাঙনরোধের সমাধানই বা কী? জবাবে স্থানীয়রা তুলে ধরেন তাদের মতামত।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রামগতি ও কমলনগর ঘেঁষা মেঘনায় বিগত বছর গুলোতে ভাঙনের গতি একই রকম। গত তিন বছরে এই ভাঙন আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। এরআগেও চরাঞ্চল ভেঙেছে। এখনও বাড়িঘর, স্থাপনা, ফসলি জমি সর্বনাশী মেঘনা গিলে নিচ্ছে। ভাঙ্গনের শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাজারো মানুষ। মেঘনার ভঙ্গনের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে তারা ছুটছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে।
স্থানীয় উপকূলবাসীর দাবি, মেঘনার মাঝখানে ডুবোচরের কারণে পানি চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে নদীর মাঝখান থেকে মূল স্রোত কিনারে চলে এসেছে। আর এই পথে নৌ-যান চলাচল করার কারণে দিনে দিনে মেঘনার তীর ভেঙ্গেই চলছে অবিরাম।
মেঘনা ভাঙনের তীরে বাড়িঘরের শেষ চিহ্ন সুপারি গাছ, নারিকেল গাছ, সাজানো গোছানো ঘরের ভিটেমাটি, উঠান, সবই পড়ে আছে শুধু ঘরটাই নেই। বাড়ির লোকজন মাঝে-মধ্যে যত্নে গড়া বাড়ির গাছগাছালি আবেগের টানে দেখতে আসেন। বাড়িটির আশা হয়তো তারা ছেড়েই দিয়েছেন, তারপরও স্বপ্ন দেখেন ভাঙন থেমে গেলে কিনারে এসে বাড়ির ভিটেমাটি রক্ষা পেতে পারে। যারা এতটুকু আশাও করতে পারছেন না, তারা অনেক কষ্টে নারিকেল-সুপারি গাছে কুঠারের ঘা বসাচ্ছেন। নারিকেল-সুপারি না পাওয়া গেলেও গাছগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন।
রামগতির আলেকজান্ডার বাজারের দক্ষিণে আদালতপাড়ার মাথা থেকে দক্ষিণে প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীর তীরবর্তী রাস্তা খেয়ে নিয়েছে রাক্ষুসী মেঘনা। বয়ারচর, বড়খেরী, গাবতলী, কুমারখালি, আসলিপাড়া, সেবাগ্রাম, আসলীপাড়া, কাঁটাবনিয়া, চরআবদুল্ল্যা, লম্বাখালীসহ প্রায় ১৮টি গ্রামের কোন অস্তিত্ব নেই। একইসাথে প্রায় ১৭ কি.মি. বেঁড়ী, সুইচ গেইট, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, ৭টি সাইক্লোন সেন্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদ, বিভিন্ন স্থাপনা ও মানুষের হাজার হাজার বসত বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে রামগতি ও আলেকজান্ডার বাজারের অতি নিকটে মেঘনা নদী চলে আসায় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
রামগতি দ্বায়রা বাড়ির পীর মোমিন হুজুরের সমাধীস্থল, লক্ষ্মীপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান বানী ভবানী কামদা মঠ, উপজেলা পরিষদ, নৌ-ফাঁড়ি থানা, রামগতি থানা, প্রাণিসম্পদ দপ্তর, আ,স,ম, রব কলেজ, রামগতি রব্বানিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, ভূমি অফিস ও সবচেয়ে বেশী হুমকীর মুখে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এমনকি রামগতি এবং আলোকজান্ডার বাজার।
ভাঙনরোধে যথাযথ পরিকল্পনা না নেওয়ায় ক্ষোভ কমলনগরের মেঘনার পাড়ের মানুষেরও। গত এক বছরে সোয়া কিলোমিটার জনপদ নদীতে হারিয়েছে। এ পর্যন্ত ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ স্থানান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন বলে ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নদী ভাঙনরোধ এখন একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কেননা রাজনৈতিক নেতা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের উদাসীনতায় ভাঙ্গনরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অনেক রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার পালাবদলের ইস্যু হিসাবে নদীভাঙন সমস্যা জিইয়ে রাখতে চান।
উপকূলীয় বাসিন্দাদের দাবি, নদীভাঙ্গন রোধের পরিকল্পনায় মাঠের তথ্য স্থান পাচ্ছে না কেননা পরিকল্পনায় উঠে আসছে না বাস্তব চিত্র। নদীভাঙ্গন সমস্যা সমাধানে পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। মাঠের তথ্যের ভিত্তিতে সঠিকভাবে সমীক্ষা করতে হবে এবং ড্রেজিং করে পানি নিষ্কাশনের পথ ঘুরিয়ে দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত মেঘনা নদীর মধ্যখানে জেগে উঠা ডুবো চরগুলো জ্রেজিং করে নদীর স্রোতের গতিপথ সোজা করে দিয়ে নদীর স্রোতধারা যথানিয়মে প্রবাহিত হলে। নদীর কূলঘেষে চলাচল করা আভ্যন্তরিণ নৌ রুটে চলা বড় বড় জাহাজ, ষ্টিমারসহ সকল প্রকার নৌ চলাচলে কতৃপক্ষের সঠিক তদারকি করণ, বিগত দশ বছরে ভেঙ্গে যাওয়া অন্তত ৪টি বেঁড়ীবাধের পরিবর্তে শক্তিশালী বেঁড়ীবাধ নির্মাণ করা, বিভিন্ন জনপদে নদীর তীরবর্তীস্থানে ব্লকবাঁধ-প্যালাসাইটিং নির্মাণসহ বন বিভাগের মাধ্যমে সবুজ বনায়নের ব্যবস্থা করা হলে ভাঙন রোধ সম্ভব হবে নচেৎ এক সময় বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে রামগতি এবং কমলনগর নামের উপজেলাটি মুছে যাবে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।