- হোম
- >
- বায়োগ্রাফি
- >
- রণেশ দাশগুপ্ত
রণেশ দাশগুপ্ত
রণেশ দাশগুপ্ত (১৫ জানুয়ারি ১৯১২ - ৪ নভেম্বর, ১৯৯৭) সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগ্রামী রাজনৈতিক কর্মী ও দেশের স্মরণীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
জন্ম: রণেশ দাশগুপ্তের জন্ম ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারি আসামের ডিব্রুগড়ে। সেকালের আর দশটা মেয়ের মতোই মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্ত প্রসব-পূর্বে চলে গিয়েছিলেন আসামের ডিব্রুগড়ে-তাঁর পিত্রালয়ে। সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন রণেশ দাশগুপ্ত।
মা-বাবা: মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্ত; বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত, ভাইবোন: চার ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান, কিন্তু প্রথম পুত্র। এই পরিবারের প্রথম সন্তানের নাম প্রতিভা দাশগুপ্ত, ডাকনাম ডলি। রণেশ দাশগুপ্তের অন্য ভাইবোনের কয়েকজন হলেন: শেফালি দাশগুপ্ত (খুকি), প্রবীর দাশগুপ্ত, অজিত দাশগুপ্ত (ছুটু)। রণেশ দাশগুপ্তের ডাকনাম ছিল খোকা।
শৈশব ও শিক্ষারম্ভ: রণেশ দাশগুপ্তের শৈশব কাটে ভারতের পুরুলিয়াতে। পুরুলিয়ায় রামপদ পণ্ডিতের পাঠশালায় রণেশ দাশগুপ্তের হাতেখড়ি হয়। পরে রাঁচি জেলা স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে।
কলেজ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা: ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে বাঁকুড়া খ্রিশ্চিয়ান কলেজে ভর্তি; পরের বছর সেখান থেকে রাজনৈতিক কারণে বহিষ্কার। তারপর কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে আই. এসসি. পাস। বরিশালে আগমন ও বি. এম. কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি. এ. শ্রেণিতে ভর্তি। নতুন বাসস্থান জেঠু সত্যানন্দ দাশগুপ্তের বাসভবন ‘সর্বানন্দ ভবনে’। রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা এবং বাড়ীতে বেশি বেশি লোক এসে ভীড় জমানোর কারণে অবশেষে বিএম কলেজ ছাত্রাবাসে। বি. এ. পাস না করেই ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে বরিশাল থেকে ঢাকায় আগমন।
রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা: রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা বলা চলে তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। স্বদেশী বিপ্লবী প্রায় প্রতিটি আন্দোলনেই তাঁর পরিবারের একটা বড় সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। রণেশ দাশগুপ্তও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছিলেন একেবারে স্কুলজীবনে। ‘টেকনিক্যাল স্কুলে’র ছাত্র তাঁর চেয়ে বয়সে সামান্য বড় হরিপদ দে তাঁকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। তিনি ‘অনুশীলন গ্র“পের’ সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাঁচিতে থাকতে হরিপদ দে’-র সঙ্গে পরিচয়-আলাপ আর পার্টির লিটারেচার পড়ে অনুশীলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং সেই থেকেই এর সূত্রপাত। তবে কলেজে এসে যেন রাজনীতি তাঁকে পেয়ে বসল। মাথায় ছিল ব্রিটিশ বিরোধিতা। তাই স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে তাঁর নেতৃত্বে কলেজের তিনজন ছাত্র মিলে বাঁকুড়ায় প্রথম ভারতীয় পতাকা তোলা হয়। সেটা ১৯৩০ এর জুলাই মাস। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া এতই মারাত্মক হলো যে, কলেজ থেকে তাঁকে বের করে দেয়া হলো। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে আইএ পাশ করার পর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে পাবিারিক চাপে তাকে চলে যেতে হয়েছিল বরিশালে। সেখানে গিয়ে বরিশাল বি. এম. কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি. এ. শ্রেণিতে ভর্তি হন রণেশ দাশগুপ্ত, সেখানেও যুক্ত থাকেন রাজনীতিতে। বিএম কলেজ ছাত্রাবাসে থাকা অবস্থায় ‘জাগরণী গোষ্ঠী’ নামে একটি বিপ্লবী গ্র“প সংগঠিত করেন। পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা মিউনিসিপ্যাল্টির কমিশনার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন।
কারাবাস: রণেশ দাশগুপ্ত প্রথম কারাবরণ করেন ১৯৪৮ সালের ১০/১১ মার্চ। বাংলা ভাষার পক্ষে প্রচারণার জন্য ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে তিনি গ্রেফতার হন এবং বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেন। তাঁকে ঐ বছরের ৭ জুন পুনরায় গ্রেফতার করে বিনা বিচারে ঢাকা কারাগারে আটক রাখা হয়। ১৯৪৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে রাজবন্দিরা তিনবার অনশন ধর্মঘট করেন। চতুর্থবারের ধর্মঘটে সরকার কর্তৃক কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়। দীর্ঘ ৭ বছর ৮ মাস কারাভোগের পর ১৯৫৫ সালে তিনি কারামুক্ত হন। এরপর তিনি ‘রেজা’ ছদ্মনামে আত্মগোপন করেন। ১৯৬২ সালে সামরিক আদেশ বলে তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৩ সালে মুক্তি পান। এরপর ১৯৬৫ সালে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। এ পর্যায়ে তিনি তিন বছর কারাভোগের পর ১৯৬৮ সালে কারামুক্ত হন। দীর্ঘ ৭৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে প্রায় ১২ বছর তাঁকে কারাগারে অবরুদ্ধ থাকতে হয়।
কর্মজীবন: প্রথাগত চাকরির অভিলাষী ছিলেন না রণেশ দাশগুপ্ত। ১৯৩৮ সালে ঢাকাতে নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার সহকারি সম্পাদক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পিতার মৃত্যুর পর সংসারের অর্থাভাব মেটাতে একটি ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে তাঁকে চাকরী নিতে হয়। ১৯৫৫ সালে কারামুক্তির পর স্বল্প সময়ের জন্য তিনি ইত্তেফাকে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বামপন্থীদের পরিচালিত দৈনিক সংবাদ-এ যুক্ত হন। ১৯৭৫-পর্যন্ত এ সংযুক্তি অব্যাহত ছিল। এরপর পশ্চিমবঙ্গ-জীবনে আর কোথাও কর্মসূত্রে সম্পৃক্ত তিনি ছিলেন না।
সাহিত্যকর্ম: লেখক রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক। তাঁর কাছে সাহিত্য নিছক সাহিত্যের জন্য নয়; সাহিত্য হল বাস্তব সমাজ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি। ১৯৫৬ সালে আত্মগোপনে থাকাকালে তিনি মাও সে তুং-এর ‘শত ফুল ফুটতে দাও’-এর অনুবাদ করেন এবং কার্ল মার্কসের জীবনী রচনা করেন। ১৯৫৯ সালে ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’ প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য অঙ্গনে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। কারাগারে থাকাকালীন সময়ে প্রকাশিত হয় ‘আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম’ (১৯৬২), ‘শিল্পির স্বাধীনতার প্রশ্নে’ (১৯৬৬) ইত্যাদি। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়- ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম (১৯৭০), আলো দিয়ে আলো জ্বালা (১৯৭০), রহমানের মা ও অন্যান্য গল্প (১৯৮৪), আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ (১৯৮৬)
সেদিন সকালে ঢাকায় (১৯৮৭), সাজ্জাদ জহীর প্রমুখ (১৯৮৮), মুক্তিধারা (১৯৮৯), সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা (১৯৯৪)। এছাড়াও তিনি হেনরি এলেগের দ্য কোয়েশ্চেন-এর অনুবাদ, ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা-অনুবাদ, জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার সম্পাদনা, গোর্কি-মায়াকোভস্কি-নেরুদার কবিতাসংকলন, স্বাধীনতা-সাম্য-বিপ্লবের কবিতা এবং অসংখ্য অগ্রন্থিত প্রবন্ধ ও কিছু অমর কবিতা রচনা করেন। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে সাহিত্য ছিল তাঁর জীবনসঙ্গী।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।