ইট ভাটার কাঁদা মাটিতে চাপা পড়ছে অসংখ্য শিশুর শিক্ষা জীবন
তিন বছর আগেও স্কুলে পড়ছিল ফারুক, রাসেল, কেয়া, আর জান্নাতুল। কিন্তু এখন আর পড়ে না। কারণ লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার কলিমুদ্দিন-ফুলমতি দম্পতির ওই ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর ৬ মাসের জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন শত শত মাইল দূরের ইট ভাটায়। সেখানে সংসারের দরিদ্রতা জয়ে বাবা-মায়ের সাথে ইট তৈরীতে অংশ নেয় তারা। এতে করে কিছুটা আয় উপার্যন হলেও ইট ভাটার ওই কাঁদা মাটিতেই চাপা পড়েছে এসব শিশুর শিক্ষা জীবন! এমন ঘটনা শুধু ওই পরিবারে নয় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার হাজার হাজার শ্রমিক পরিবারের।
জানা যায়, জেলার হাতীবান্ধা উপজেলা থেকে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ প্রতিবছর স্বপরিবারে পাড়ি দেন নরসিংদির বিভিন্ন ইট ভাটায়। এবছরও শুরু হয়েছে ওইসব পরিবারের দরিদ্রতা জয়ের যাত্রা। তবে অতীতের যেকান সময়ের চেয়ে এবছর সর্বাধিক মানুষজনকে স্বপরিবারে ইট ভাটায় যেতে দেখা গেছে।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা রেলগেট এলাকায় বিকেল হলে দেখা মেলে শত শত পরিবারের। সেখান থেকে ১০/১২ টি বাসে করে নরসিংদির ইট ভাটার উদ্দেশ্যে ছুটছেন স্বপরিবারে। এছাড়াও উপজেলার সানিয়াজান বাজার, দোয়ানী মোড় সিংঙ্গীমারী শস্য গুদাম এলাকা থেকেও বাস ছাড়ে ইটভাটার শ্রমিকদের নিয়ে।
সরেজমিন পরিদর্শন কালে দেখা যায়, এসব শ্রমিকবাহী বাসের অর্ধেকেরও বেশী কোমলমতি শিশু। বাবা-মায়ের সাথে তারাও যাচ্ছেন ৬ মাসের জন্য ইট ভাটায়। এদের মধ্যে কথা হয় শিশু রাসেলের সাথে। বাবা কলিমুদ্দিন আর মা ফুলমতির সাথে তাঁরা চার ভাইবোন কয়েক বছর থেকে ইট ভাটায় যাচ্ছে।
রাসেলের মতে, তিন বছর আগে সে ৫ম শেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে, বড় ভাই ফারুক ৭ম শ্রেনী আর ছোটবোন কেয়া তৃতীয় আর সবার ছোট জানাতুল দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ইট ভাটার যাওয়া শুরু হয়। এরপর সেখান থেকে ৬ মাস পর বাড়ি ফিরে স্কুলে যাওয়া হয়নি তাদের। একই অবস্থা ইট ভাটার কাজে যাওয়া অন্যান্য পরিবারের শিশুদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নরসিংদির মনোহরদি উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন ইট ভাটার মালিকরা প্রতিবছর বাইরে থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করেন। সেখানে শ্রমিকদের জন্য রয়েছে স্বপরিবারে থাকার ব্যবস্থা। শ্রমিকদের সর্দারের মাধ্যমে অগ্রীম টাকা দেওয়া ইট ভাটার মালিকরা। চলতি বছর প্রায় ১০ জন শ্রমিক সর্দারের মাধ্যমে ওই অগ্রীম টাকা বিতরণ করা হয়েছিল। সেই টাকা নিয়ে এখন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার হতদরিদ্র হাজার হাজার দম্পতি তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ইট ভাটর কাজে যোগ দিচ্ছেন।
এসব শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওইসব ভাটায় একটি কাঁচা ইট তৈরীতে তিন জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এদের মধ্যে প্রথম শ্রমিক লাইন ধরে মাঠে মাটি ফেলেন, দ্বিতীয়জন সেখান থেকে পরিমানমত মাটি মুঠি মুঠি করে সারিবদ্ধ করে রাখেন। আর তৃতীয়জন বিশেষ ফর্মা বা বাক্স দিয়ে পরিপূর্ণ একটি কাঁচা ইট প্রস্তুত করেন। এভাবে তিন জন শ্রমিকের সহায়তায় প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার ইট তৈরী হয়। এর ফলে যে পরিবারে তিনজন সদস্য থাকে তারা প্রতিদিনের কাজে আয় আসে প্রায় এক হাজার টাকা। আর তাই অধিকাংশ শ্রমিক দম্পতি ইট তৈরীতে তাদের স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের কাছে সহায়তা নেন বলে জানা গেছে।
এদিকে ইটভাটায় কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েরা অধিকাংশই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার স্কুলে অনুপস্থিতির হার আশংকা জনক হারে বেড়ে গেছে। এরমধ্যে হাতীবান্ধা চর গড্ডিমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সারডুবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গড্ডিমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পন্ডিতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিত্তিফাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নিজ গড্ডিমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বড়খাতার আদর্শ গ্রাম শিক্ষা উৎসাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুপুস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশী বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক ওইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, অনেক বাচ্চা তাদের অজান্তে বাবা-মায়ের সঙ্গে ইট ভাটায় গেছে। আবার কোন শিক্ষার্থীদের ইট ভাটায় না নিয়ে যেতে তাদের অভিভাবকদের অনুরোধ করলেও শিক্ষকদের কথা শ্রমিকরা শোনননি বলে জানা তিনি। এতে করে ইট ভাটায় কাজ করা পরিবার গুলোর সন্তানেরা দিনে দিনে তাদের শিক্ষা জীবন থেকে ঝড়ে পড়ছে বলে জানা গেছে।
তবে হাতীবান্ধা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (টি,ও) আব্বাস উদ্দিন বলেন, শ্রমিকদের সাথে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ইট ভাটায় যাওয়ার খবরটি তাঁর জানা নেই। তবে আগামি কাল থেকে এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিবেন বলে জানান তিনি।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।