এই জানোয়ারের যত অপকৃতি
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি সৃষ্টি জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে গো. আযম শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করেছিলেন। এসব বাহিনী একাত্তরে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধ করেছে। গোলাম আযম এসব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। সে সময় তিনি তার অনুসারীদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারতেন। কিন্তু সজ্ঞানে তিনি তা করেনি।
গো. আযম ছিল গণহত্যার প্রতীক, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার শিরোমণি। এই রাজাকার গুরু আমৃত্যু ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা এই দেশের বিরোধীতা করে গেছে।
গো. আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা ও তাদের সঙ্গে চক্রান্তের দায়ে ৬টি, পরিকল্পনার দায়ে ৩টি, উস্কানির ২৮টি, সম্পৃক্ততার ২৩টি এবং ব্যক্তিগতভাবে হত্যা-নির্যাতনের ১টিসহ মোট ৬১টি অভিযোগ আনা হয়েছিল।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, হত্যাকাসায় ও সহযোগিতার দায়ে গত বছরের ১৫ জুলাই তাকে নব্বই বছর সাজা দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
রায়ে বলা হয়, গোলাম আযমের যে অপরাধ তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি পাওনা হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থার বিবেচনায় এই অশীতিপরকে ফাঁসির বদলে ৯০ বছর কারাদন্ড দেওয়া হলো।
ট্রাইব্যুনাল পাঁচ ধরনের অভিযোগের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার দায়ে ১০ বছর করে ২০ বছর, উস্কানির দায়ে ২০ বছর, অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করার দায়ে ২০ বছর এবং হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়ায় ৩০ বছর কারাদন্ড দেন গোলাম আযমকে।
গো. আযমের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা ৬১টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এরমধ্যে একাত্তরের ২১ নভেম্বর গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারের ৩৮ জনকে শহরের পৈরতলা রেলব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। এই গণহত্যা হয়েছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গো. আযমের নির্দেশে।
অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারাদেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গো.আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। এরপর ৪ মে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে গো.আযমের উপস্থিতিতে শান্তি কমিটির সভা হয়। খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে ওই সভায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনা করা হয়।
গো.আযমসহ অন্যরা একাত্তরের ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। গো.আযমের সহযোগিতায় ৯ এপ্রিল নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এরপর ১৫ এপ্রিল এর নাম বদলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি করা হয়। শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের কার্যকরী কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি।
১৮ জুন পাকিস্তানের লাহোর বিমানবন্দরে গো.আযম বলেন, জনগণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে চায়। ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে তিনি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান। পরদিন লাহোরে জামায়াতের পশ্চিম পাকিস্তান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গো. আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে 'দুষ্কৃতকারীরা' সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের প্রতিরোধে ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রসজ্জিত হওয়া উচিত।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্যতম হোতা গো. আযম প্রধানত সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন দায়) জন্য দায়ী প্রমাণিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন বাঙালি হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, সম্পৃক্ততা, হত্যা ও নির্যাতনজনিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন অবস্থানে থাকায় একক এবং যৌথ অপরাধের দায়-দায়িত্বের জন্যও তাকে দায়ী করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়, গো. আযম কেবল নিজের কৃত অপরাধের জন্যই দায় বহন করেন না, বরং তার ঊর্ধ্বতন অবস্থানের কারণে তার অধীন এবং প্রভাবাধীন সাংগঠনিক পরিকাঠামোর অধীনে বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের করা অপরাধের দায়ও তার ওপর বর্তায়।
রায়ে বলা হয়, একাত্তরে দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়েছিল। একদিকে ছিল আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামী সংগঠন এবং ধর্মীয়ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়। অন্যদিকে, ছিল কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও বিহারিরা। এসব দলের মধ্যে বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ব্যাপক স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা চালায়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাত্তরে ম্যাসিভ জেনোসাইড হয়েছে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ। এটাকে কেবল নাৎসি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। সেই হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং সর্বোচ্চ নেতাদের দৃষ্টিতে আসামির প্রকৃত ঊর্ধ্বতন অবস্থান এবং সে অনুসারে এর স্বীকৃতির প্রমাণ মেলে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ এবং দেশব্যাপী গণহত্যার পর থেকে শুরু করে গো. আযমের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে পাকিস্তানি শাসক এবং সামরিক আইন প্রশাসকদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে যাওয়ার ঘটনা থেকে।
লেখক: সাংবাদিক
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।