ছড়াসাহিত্য : চাই নতুন পথ নতুন মত
ছড়া আসলে কোন দিকে যাচ্ছে?
খুব সত্য, ছড়াবিষয়ক সমালোচনামূলক সাহিত্যচর্চা গড়ে ওঠেনি। আন্তরিকভাবে কলমও ধরেননি কোনো সমালোচক-গবেষক। যে কারণে এই প্রশ্নের সহজ উত্তরও মেলে না। যেভাবে গল্প, কবিতা বা উপন্যাসের সাম্প্রতিক চর্চার ধরন আলোচিত হয়, ঠিক সেভাবে সমালোচক-গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্ব পায়নি ছড়ার ক্ষেত্রে। আলোচিত হয়নি বর্তমান ছড়ার রূপ, গতি-প্রকৃতি কিংবা ছড়াকারদের নিবেদিত শক্তিমত্তা সম্পর্কে। এমনকি সাহিত্য সম্পাদকদের আগ্রহও দেখা যায় না সাহিত্য পাতায় ছড়াবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করতে।
তো এই যখন সামগ্রিক চিত্র তখন আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি এরকম- সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারে ছড়াকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই, কারণ ছড়ার এক সম্প্রসারিত রূপই হচ্ছে কবিতা। ছন্দ থেকেই ছড়া শব্দটি এসেছে। কারো মতে ‘ছটা’ শব্দ থেকে ছড়া শব্দটির উৎপত্তি। নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত ‘বাংলা বিশ্বকোষ’ গন্থে ‘ছড়া’ শব্দটিকে দেশজ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, বিস্তৃত পদ্য বিশেষ। এর মূলে আছে ঐতিহ্যাশ্রয়ী ছন্দ। লোকজ ধারায় রচিত ছড়া সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ছড়া ছন্দে গাথা গ্রাম্য উক্তি। অনেকের কাছে ছড়াকে ছন্দে গাথা আর ছড়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ছন্দময় অনুভূতি। বাংলা ছড়ার আদি উৎস খুঁজতে গেলে দৃষ্টি পড়ে লোকজ ছড়ায়। গ্রাম্য কবিতা, ধাঁধা, খনার বচন-এসবের আবরণে ছড়ার প্রাণভোমরাকে খুঁজে পাওয়া যায়।
লোক গবেষকদের মতে, বাংলার ঐতিহ্যাশ্রয়ী ছড়াগুলি কালের বিচারে প্রাচীন। এ অবস্থায় সব ভাষা ছন্দই গানের সুর ও নাচের তালের সঙ্গে বিশেষ ভাবে যুক্ত, পরে ভাষার ক্রমবিকাশ ছন্দকে নানা রূপ দেয়, আর এ ক্রমবিকাশের সূত্রপাত ঘটে লেখন পদ্ধতি ও ছাপাখানার ক্রমবিকাশকে কেন্দ্র করে। কিন্তু মানুষ দীর্ঘদিন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছন্দকে ভুলতে পারেনি। একালে স্বজ্ঞানে সাহিত্যের অঙ্গরূপে অনেকেই ছড়া রচনা করে থাকেন—এগুলি সচেতন সাহিত্য সৃষ্টি, অতএব লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং প্রাচীন ছড়ার সঙ্গে একই মাটির হাঁড়িতে রাখা সঙ্গত হবে না। শব্দচয়নের দিক দিয়েও একাল-সেকাল দুই কালের ছড়ার পার্থক্য লক্ষণীয়। বাংলার বিপুল ছড়ার ভাণ্ডার প্রথমত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে :
১। লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত গ্রাম্য ছড়া
২। পরিশীলিত সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত নাগরিক ছড়া
[সংগৃহীত তথ্য : বাংলার ছড়া ছড়ার বাংলা, সম্পাদনা : সৌগত চট্টোপাধ্যায়]
ছড়া লৌকিকতার গণ্ডি ভেঙে লাবণ্যে পরিপূর্ণতা পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। ১৩০১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ প্রবন্ধটি ‘সাধনা’ পত্রিকায় আশ্বিন-কার্ত্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
বাংলা ভাষায় ছেলে ভুলাইবার জন্য যে সকল মেয়েলি ছড়া প্রচলিত আছে, কিছু কাল হইতে আমি তাহা সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত ছিলাম। আমাদের ভাষা এবং সমাজের ইতিহাস-নির্ণয়ের পক্ষে সেই ছড়াগুলির বিশেষ মূল্য থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে যে একটি সহজ স্বাভাবিক কাব্যরস আছে সেইটিই আমার নিকট অধিকতর আদরণীয় বোধ হইয়াছিল।
রবীন্দ্রনাথ ছড়াকে আত্মস্থ করেছেন শিল্পবোধের জায়গা থেকে। তার প্রকাশ এই উদ্ধৃতির মধ্যে পাওয়া যায়-
ছড়ার মধ্যে একটা চিরত্ব আছে। কোনোটির কোনো কালে কোনো রচয়িতা ছিল বলিয়া পরিচয়মাত্র নাই এবং কোন্ তারিখে কোনটা রচিত হইয়াছিল এমন প্রশ্নও কাহারও মনে উদয় হয় না। এই স্বাভাবিক চিরত্বগুণে ইহারা আজ রচিত হইলেও পুরাতন এবং সহস্র বৎসর পূর্বে রচিত হইলেও নূতন।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার ‘খুকুমণির ছড়া’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ সংকলিত করেন। সেই গ্রন্থের ভূমিকায় ছড়াকে প্রথমবারের মতো সাহিত্যের বিষয় বলে উল্লেখ করেন আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী।
লৌকিক ছড়াপাঠকে রবীন্দ্রনাথ শৈশবের মেঘদূত হিসেবেই চিত্রিত করেছেন। আর এই বোধটাকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন শিশুদের মাঝে। মেয়েলি ছড়া এবং ছেলেভুলানো ছড়া নামে ছড়াকে দুই ভাগে চিহ্নিত করে রবীন্দ্রনাথ ছড়ার বিষয় হিসেবে তুলে এনেছেন জগত সংসারের নানান বিষয়। ১২৯২ বঙ্গাব্দে ‘বালক’পত্রিকায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ ছড়াটি রবীন্দ্রনাথের হাতে আধুনিক চেহারা পেয়েছে। এই ছড়াটি রবীন্দ্রনাথ নিজে সংগ্রহ করেন এবং সে বিষয়ে অনবদ্য ভাষ্য রচনা করেন। ছড়াটি হল-
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।
শিবঠাকুরের বিয়ে হ’ল তিন কন্যা দান ॥
এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যে খান।
এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ি যান ॥
উল্লেখিত ছড়াটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন—
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান। এই ছড়াটি বাল্যকালে আমার নিকট মোহমন্ত্রের মতো ছিল এবং সেই মোহ এখনো আমি ভুলিতে পারি নাই। আমি আমার সেই মনের মুগ্ধ অবস্থা স্মরণ করিয়া না দেখিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারিব না ছড়ার মাধুর্য এবং উপযোগিতা কী। বুঝিতে পারিব না, কেন এত মহাকাব্য এবং খণ্ডকাব্য, এত তত্ত্বকণা এবং নীতিপ্রচার মানবের এত প্রাণপণ প্রযতœ, এত গলদধর্ম ব্যায়াম প্রতিদিন ব্যর্থ এবং বিস্মৃত হইতেছে, অথচ এই-সকল অসংগত অর্থহীন যদৃচ্ছাকৃত শ্লোকগুলি লোকস্মৃতিতে চিরকাল প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে।
১৯৪০ পর্যন্ত প্রচলিত ছড়ার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে শিশুদের নৈতিক শিক্ষাদানের বিষয়। আর এমনই সময় সুকুমার রায়ের আবির্ভাব ছড়ার আকাশে নতুন সূর্য হয়ে উদিত হয়। শব্দ চয়নে, ছন্দে, ব্যঞ্জনায় এবং বিষয় বৈচিত্র্যে সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যে ছড়ার মাধ্যমকে নতুন মাত্রায় অলংকৃত করেন। সুকুমার রায়ের ধারাবাহিকতায় ছড়ার মধ্য দিয়ে যুক্ত হতে থাকে সমকালীন বিষয়-আশয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিবাদ, ক্ষোভ, দুর্ভিক্ষ- এসবের ছবি ছড়ার মধ্য দিয়ে লিখিত হতে থাকে। এক সময় যে ছড়া মুখে মুখে প্রচলিত ছিল সেই ছড়া নতুন আবরণে, নতুন বক্তব্যে, নতুন ছন্দ-তালে প্রচলিত দেয়াল ভেঙে লিখিত আকারে, মুদ্রিত আকারে প্রকাশ পেতে থাকল সাহিত্যের পাতায় পাতায়। ছড়ার এক নতুন বিনির্মাণ শুরু হলো। আর এই বিনির্মাণের পুরোধা হয়ে এলেন বাংলা ছড়ার আধুনিক রূপকার অন্নদাশঙ্কর রায়।
তেলের শিশি ভাঙলো বলে
খুকুর ’পরে রাগ করো
তোমরা যারা বুড়ো খোকা
তার বেলা, তার বেলা?
আধুনিক ছড়ার এক অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়ার এই পঙ্ক্তিমালায়। লোকগবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী আধুনিক ছড়ার আঙ্গিক প্রসঙ্গে লিখলেন-
ছড়া শুধু সমাজ সংসার নিয়ে বলে না, দেশ ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বলে। ... ছড়া কালের সাথে অনবরত তার রূপ বদলায়।
সেই থেকে ছড়া নিঃসন্দেহে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। বদলেছে উপস্থাপন রীতি। বদলেছে বিষয়-ভাবনা ছন্দ। বদলেছে চিত্রকল্প। বাংলা সাহিত্যে ছড়ার এই বদলে যাওয়া রূপের কারিগররা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ, বন্দে আলী মিয়া, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, সুফিয়া কামাল, আহসান হাবীব, হোসনে আরা, হাবিবুর রহমান, সরদার জয়েনউদ্দীন। সময়ের হাত ধরে বাস্তবতার নিরিখে ছড়া নতুন মাত্রায় বিকশিত হয়েছে। যাদের হাতে হয়েছে আমরা তাদেরকে ছড়াকার হিসেবেই চিনি এবং জানি।
বাংলাদেশে গত চার দশকের ছড়ায় গুণগত বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। ষাটের দশকে ছড়ায় প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রভাবনার উত্তরাধিকার। যেখানে প্রভাব পড়েছে লোকজধারা। সত্তরের দশকে ছড়ায় দেখা গেছে অন্তঃমিলগত নতুন ছন্দ খোঁজার প্রবণতা এবং আশির দশকে সমসাময়িক ঘটনার আলোকে জীবনবোধের ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গি। নব্বইয়ে ছড়ার মাঝে পাওয়া গেছে রাজনৈতিক ধারার স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ নির্মাণ কৌশল। সেই সঙ্গে বিষয়বৈচিত্র্য।
দশকওয়ারি বিবেচনায় ছড়া-চর্চার ক্ষেত্রে সৌন্দর্য সচেতন রীতির প্রকাশ ঘটলেও মূলত সত্তরের দশকে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্বাক্ষর স্পষ্ট হয়েছে ছড়াকারদের রচনায়। যার ধারাবাহিকতা আশির দশকেও বিদ্যমান। তবে এ সময়টাতে কখনো শব্দ নিয়ে, কখনো বা আঙ্গিক নিয়ে, কখনো বা বিষয়বৈচিত্র্য নিয়ে ছড়াকাররা উজ্জ্বলতম প্রকাশভঙ্গি দেখিয়েছেন। আর যে কারণে কেউ কেউ পাঠকদের কাছে চিহ্নিত হয়েছেন বুদ্ধিবৃত্তিক ছড়া রচনার গুণে।
কবি আল মাহমুদের কাছে ছড়া প্রকৃতপক্ষে কবিতা। তাঁর মতে, আধুনিক কবিতার একটা বড় লক্ষণ হলো বিদ্রƒপ। ছড়ার মধ্যে সেটা আছে। যে কারণে আল মাহমুদ মনে করেন, প্রকৃত ছড়া হলো তা, যে লেখায় কবিতা থাকে।
পঞ্চাশের দশক বাংলাদেশের কবিতার উজ্জ্বল দশক। আর এই দশকে প্রকরণগত নিষ্ঠার সাথে কাব্যরচনায় যেসব কবি শিল্পগুণের আলোয় আলো ছড়িয়েছেন তাঁদের অনেকেই ছড়ার জন্য কলম ধরেছেন। ছড়াসাহিত্যের জন্য এটা পরম পাওয়া।
শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একই বিবেচনায় ছড়াসাহিত্যের কাছে উত্তরাধিকারী হয়ে সমর্পিত হলেন ষাটের দশকের কবি মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যে যে নতুন পথ আবিষ্কারের মেরুকরণ তৈরি হতে লাগলো সেই আবেগে ছড়ার জন্য নিবেদিত হলেন ষাটের আরো কবি। মহম্মদ নূরুল হুদা, আবু কায়সার, অরুণাভ সরকার, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মাকিদ হায়দার, অসীম সাহা, মাহবুব সাদিক। ছড়ার উপজীব্য ও ভাষার ক্ষেত্রে লোকজধারার প্রভাব থাকলেও ছড়াগুলো সর্বদাই আনন্দময় ও উচ্ছল আবেগের প্রকাশ ঘটাতে লাগলো।
তবে পঞ্চাশের কিংবা ষাটের মতো সত্তরের কবিদের উপস্থিতি ছড়ায় ততটা উজ্জ্বলতা নেয়নি। নাসির আহমেদ, শিহাব সরকার, ফারুক মাহমুদের মতো হাতে গোনা ক’জন কবি ছড়ার জন্য নিবেদিত হলেন। কিন্তু আশির দশকে এসে কবিতা রচনাকারী কবিদেরকে ছড়ার প্রতি আগ্রহ লক্ষ করা গেল না। নব্বইতে তো না-ই। আর শূন্যের দশকের কবিরা তো ভাবেন কবিতা লিখবে কবি। কবি কেন লিখবে ছড়া? এই বোধের উদয় হয়েছে বলে সত্যিকার অর্থে এ দেশের সাহিত্য চর্চার মূল স্রোত থেকে ছড়া সম্পূর্ণই আলাদা হয়ে যেতে থাকে। পঞ্চাশ-ষাটের কবিরা ছড়ার জন্য মনোযোগী থাকলেন বটে, তাদের উত্তরাধিকার আশি-নব্বই-শূন্যের দশকের কবিরা শূন্যই করে রাখলেন বাংলা ছড়ার ভাণ্ডার। আর ছড়া লিখলেন, ছড়াকাররাই। তবে যারা কবিতার পথ বেয়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নকাতরতায় নিবেদিত, যাদের গন্তব্য কবিতার দিকেই এদের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে টোকন ঠাকুর ও রনজু রাইমের মতো দুজন তরুণ কবিকে খুঁজে পাওয়া গেছে যারা ছড়াও লিখছেন।
বাংলাদেশে সাহিত্য চর্চায় সত্তরের দশকেই শুধু ছড়াকে অবলম্বন করে ছড়ার জন্য সাহিত্যের পথে নতুন আন্দোলন ধ্বনিত হলো। যার অগ্রভাগে লুৎফর রহমান রিটনের নাম ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠলো। সেই সঙ্গে আবু হাসান শাহরিয়ার, ফারুক নওয়াজ, আমীরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন নাগরী, সৈয়দ নাজাত হোসেন, সৈয়দ আল ফারুক, সালেম সুলেরী, আসলাম সানী, খালেদ হোসাইন, সরকার জসীম, তুহিন রহমান চিহ্নিত হলেন ছড়া সৃষ্টির এক অভিনব নতুন মাত্রায়।
সত্তরের দশকে এসে বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্য নির্দিষ্ট মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। ছড়ার জন্য নতুন আঙ্গিক, নতুন একটা প্রেক্ষাপট এবং সপ্রতিভ ভাষা তৈরি হয়। ছড়া হয়ে ওঠে সাহিত্যের শিশুতোষ ধারা থেকে সংগ্রামরত গণমানুষের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতীক। মধ্যবিত্ত পাঠক শ্রেণির শিল্পবোধে নাড়া দিতে লাগলো ছড়া। আর ছড়ার এই তুমুল আয়োজনে পঞ্চাশ-ষাটের ছড়াপ্রেমী কবিরা তো সচল রইলেনই বরং এদের সাথে আরো যুক্ত হলেন নিরলসভাবে রোকনুজ্জামান খান, এখলাসউদ্দীন আহমদ, ফয়েজ আহমদ, সুকুমার বড়–য়া, আতোয়ার রহমান, আবু সালেহ, মাহমুদউল্লাহ, রফিকুল হক, নিয়ামত হোসেন, মাহবুব সাদিক, মাহবুব তালুকদার, আখতার হুসেন। এদেরই উত্তরাধিকারী হয়ে আশির দশকে উজ্জ্বল হয়ে উঠলাম আমরা ক’জন। আমারই সাথে নাম যাদের বলতেই হয়, ওবায়দুল গণি চন্দন, রোমেন রায়হান, সারওয়ার উল ইসলাম।
যে প্রশ্নটি শুরুতেই করেছিলাম, ছড়া আসলে কোনদিকে যাচ্ছে? সামগ্রিক বিবেচনায় ছড়াকারদের রচিত বর্তমান ছড়াগুলো অনেকটাই কী একঘেঁয়েমি? আমার ব্যক্তিগত অভিমত, হয়তো-বা। অনেক ছড়াকারদের দেখেছি অন্ত্যমিলগত ভাবনার আলোকেই ছড়া নির্মাণ করতে চান। ছড়ার জন্য এটা কখনোই সুখকর নয়। সেই আদিকাল থেকে বর্তমান সমাজচিত্রে যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। আজকের এই একুশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর জীবনযাপন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, রাজনৈতিক ডামাডোলে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ যেভাবে নতুন আঙ্গিক তৈরি করছে, ছড়া সেভাবে পারছে না। চেষ্টা যে হচ্ছে না তা না। কেউ কেউ নিরীক্ষা করছেন। চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কাল-মহাকাল বিচার করবে ছড়ার এই গুণগত মান। তবে এ কথা বলতেই হয়, গল্প-কবিতা-উপন্যাসের জন্য যেমন আধুনিক পাঠক তৈরি হয়েছে, আমি মনে করি ছড়ার জন্য সেই পাঠক তৈরি করতে হবে। এই দায়িত্ব ছড়াকারদেরই। কারণ ছড়াকাররা তাদের সৃষ্ট ছড়ায় নতুনত্ব-অভিনবত্ব-প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করলেও তা যদি পাঠকের দুয়ার পর্যন্ত সম্প্রসারিত না হয়, তাহলে ছড়ার এই নতুন সম্ভার ছড়াকারের ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, যেসব ছড়াকার বাংলাদেশের ছড়াকে বৈচিত্র্যময় করে তুলছেন, নিয়মিত লিখছেন, পাঠককে আকৃষ্ট করছেন তাদেরই এই গুরুভার বহন করতে হবে বেশি করে। কোনো দশকওয়ারি বিবেচনায় নয়, সাম্প্রতিক কালে যারা ছড়া লিখছেন তাদের মধ্যে আরো যে কয়েকটি নাম অনায়াসেই চলে আসে—সুজন বড়–য়া, আলম তালুকদার, আশরাফুল আলম পিন্টু, হাসান হাফিজ, কাজী কেয়া, রহীম শাহ, ধ্রুব এষ, নাসের মাহমুদ, রাশেদ রউফ, তপন বাগচী, বিলু কবীর, শফিক ইমতিয়াজ, মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক, ওয়াসিফ-এ খোদা, মাহবুবা চৌধুরী, জুলফিকার শাহাদাৎ, জগলুল হায়দার, আইরিন নিয়াজি মান্না, আদিত্য রুপু, আশিক মোস্তফা, কাদের বাবু, আবিদ আজম।
এটা একটা লক্ষণীয় বিষয় যে, নব্বইয়ের দশক পেরিয়ে এবং শূন্যের দশকের মাঝামাঝিতে এসেও সত্যিকার অর্থে তুমুলভাবে পাঠকনন্দিত চিহ্নিত ছড়াকার উঠে আসছে না। আশির দশকের পর থেকেই বরং এই বন্ধ্যাত্বের শুরু। কেন এই বন্ধ্যাত্ব? উত্তর জানার জন্য আমিও উদগ্রীব।
একজন কবি যেমন ফিরে যান তার নিজস্ব শেকড়ে, মাটির বন্ধনে, যেখান থেকে তুলে নেন ঐতিহ্যের গল্প, ঠিক একজন ছড়াকারও তার সময়ের কাছে, সমাজের মানুষের কাছে, ঋণী হয়ে বারবার ফিরে যান তার নিজস্ব শেকড়ে, সেই মাটির বন্ধনে।
এখন প্রশ্ন হলো ছড়া কার জন্য রচিত? কার কাছে নিবেদন করবো ছড়া? ছোটদের কাছে নাকি বড়োদের কাছে? ছড়া ছোটদের বিষয়—এই কথাটি যারা বলেন, আমি মনে করি, তারা বয়সের ধুঁয়ো তুলে ছড়াকে ছোট্ট গণ্ডির চার দেয়ালে বন্দি করতে চাইছেন। শিশুসাহিত্য বলে ছড়াকে কবিতা থেকে পাশ কাটিয়ে দিতে চাইছেন। এমনকি ছড়ার মধ্যে সমাজ জাগরণের যে বক্তব্য থাকে, সে বক্তব্যকেও শিশুসাহিত্য হিসেবে আড়াল করে দিতে চাইছেন।
এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতে চাই। তিনি শিশুসাহিত্য বলতে ছেলেভুলানো লেখাকে মানতেন না। তাই তো রবীন্দ্রনাথ লেখেন-
এখনকার দিনে শিশুদের জন্য সাহিত্য রসে প্রভূত পরিমাণে জল মিশাইয়া যে সকল ছেলেভুলানো এই লেখা হয় তাহাতে শিশুদিগকে নিতান্তই শিশু বলিয়া মনে করা হয়। তাহাদিগকে মানুষ বলিয়া গণ্য করা হয় না। ছেলেরা যে বই পড়িবে তাহার কিছু বুঝিবে এবং কিছু বুঝিবে না, এইরূপ বিধান থাকা চাই। আমরা ছেলেবেলায় একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম; যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দু-ই আমাদের মনের উপর কাজ করিয়া যাইত।
বালক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ স্বীয় বীরত্বের গৌরব কাহিনী যেমন লিখেছিলেন তেমনি লিখেছিলেন শিশু-কিশোরদের জন্য স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার আহ্বানপূর্ণ লেখা।
‘বাঙ্গালা দেশের মাঝখানে দাঁড়াইয়া একবার কাঁদিয়া সকলকে ডাকিতে ইচ্ছা করে- বলিতে ইচ্ছা করে-ভাই সকল, আপনার ভাষায় একবার সকলে মিলিয়া গান কর। বহু বৎসর নীরব থাকিয়া বঙ্গদেশের প্রাণ কাঁদিয়া উঠিয়াছে। তাহাকে আপনার ভাষায় একবার আপনার কথা বলিতে দাও। বাঙ্গলা ভাষায় একবার সকলে মিলিয়া মা বলিয়া ডাক। কেরানীগিরির ভাষা আপিসের। দরাজের মধ্যে বন্ধ রাখিয়া মাতৃস্তন ধারায় পুষ্ট মাতৃভাষায় জগতের বিচিত্র সঙ্গীতে যোগদাও। বাঙ্গালী কণ্ঠের সহিত মিলিয়া বিশ্বসঙ্গীত মধুরতর হইয়া উঠিবে’।
শিশু চেতনাকে জাগিয়ে দিতে রবীন্দ্রনাথ আরো লিখলেন আহ্বান গীত। প্রকাশ পেল ‘বালক’ পত্রিকাতেই-
... ... ...
উঠ বঙ্গ কবি, মায়ের ভাষায় মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ—
জগতের লোক সুধায় আমার সে ভাষা করিবে পান।
বর্তমান শিশুসাহিত্যের আবরণে বর্তমানে যে ছড়াগুলো আলো ছড়িয়ে আছে, এসব ছড়া রবীন্দ্রনাথেরই অনুভূতির বার্তা বহন করে। তাই ছড়া মানেই প্রজাপতির ডানা মেলা রঙিন পাখা নয়। ছড়া মানেই মেঘের ঝুমঝুমে বৃষ্টির ছন্দ নয়, হালকা চালের দুলকি তালের কোমলতা নয় ছড়া। ছড়া প্রকৃত অর্থে সমাজ-সংস্কৃতি আর জীবনবোধের গল্প নিয়েই রচিত হয়। তাই তো ছড়ায় নির্মল আনন্দ-বিনোদনের সাথে জীবন-দর্শনেরও প্রয়োজন অনিবার্য।
বাংলা শিশুসাহিত্য যখন আক্ষরিক অর্থে অবস্থান তৈরি করল, সে সময়কার শিশু আর আজকের শিশু এক নয়। এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি। সেই সুবাদে চিন্তায়-চৈতন্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক-আর্থিক প্রেক্ষাপটের মেরুকরণ হওয়ার ফলে শিশুদের চিন্তা-চেতনায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। তাদের প্রত্যাশা বহুমাত্রিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে শিশুমানসিকতায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট। ফলে সামগ্রিক চাপের কাছে শিশুদের নাগাল থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে বই। আর তাই তো ছোটদের জন্য লেখায় প্রকাশ করতে হবে সময়ের নতুন কথা। ভূত-বিলাস, আর ফুল-পাখি-প্রজাপতির তুলতুলে শব্দ দিয়ে ছড়া রচনা করার পাশাপাশি বর্তমান সময়ের চাহিদাকেও তুলে আনতে হবে। ছড়ায় ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে রাজনীতির কথা তুলে আনা দোষের কিছু নয়। আজকের ৮-১০ বছর বয়সী যে কোনো শিশু আওয়ামী লীগের নাম জানে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম জানে, বিএনপির নাম জানে, খালেদা জিয়ার নাম জানে। হরতাল কী সেটাও বোঝে। এমন কি টিভিতে নিউজ দেখে দেখে জেনে গেছে গোলাম আযমের চেহারা কেমন এবং কারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা চায়নি, তাও কিন্তু শিশুরা জানে। যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শিশুর কণ্ঠেও উচ্চারিত হতে শুনি জাগরণের স্লোগান।
‘আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি’ এটা অসম্ভব রাজনৈতিক ছড়া। কিংবা ‘আয়রে খোকন ঘরে আয়, দুধমাখা ভাত কাকে খায়’ কিংবা ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ’পরে রাগ কর, তোমরা যারা বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ কর’ এর চেয়ে সমাজের প্রকৃত চিত্র আর কী হতে পারে? তখনকার সময়ের কবি-ছড়াকাররা যদি এটা রচনা করতে পারেন—যা শিশুপাঠ্য হয়ে উঠল, এখন কেন নয়?
সাম্প্রতিক সময়ে ছড়াকারদের উপস্থিতি বেড়েছে। ছড়ার পাঠক বেড়েছে। আর তাই তো ছড়া প্রকাশের জায়গাও বেড়েছে। এটাই প্রাপ্তি। যদিও ছড়া প্রকাশের মানসম্পন্ন জায়গা নিয়ে আমার কিছুটা দ্বিমত রয়েছে। তবু বলি ছড়া লিখতে এসে একজন ছড়াকারের জন্য এতটুকু প্রাপ্তিই আনন্দের বিষয়।
ছড়া এগিয়ে চলছে। ছড়া বিকশিত হচ্ছে। ছড়ার এই বিকশিত ধারার প্রতি নিবেদিত থেকে ছড়াকারদের রচনা করতে হবে আধুনিক সময় উপযোগী বহুমাত্রিক বর্ণিল বৈচিত্র্যপূর্ণ ছড়া। এসব ছড়ার মাঝে সম্পৃক্ত থাকবে আমাদের লোকজ ধারা, থাকবে ঐতিহ্যগত চিরন্তন ছন্দের আধুনিক উপস্থাপনা। এই প্রত্যাশা ছড়া লিখিয়ে হিসেবে নয় ছড়াপাঠক হিসেবেও করছি। ছড়ার ভাষা বদলাতে হবে। বদলাতে হবে আঙ্গিক। থাকতে হবে নিরীক্ষা। থাকতে হবে জীবনবোধের গল্প। এতে করে ছোটরা তো বটেই বড়রাও তুমুল আবেগে নতুন সময়ে রচিত ছড়ার ছন্দে-আনন্দে মনটাকে রাঙিয়ে তুলতে পারবেন। চেতনায় জাগ্রত হবে নতুন সুর। ছোটদের কাছে যা শুধু ছড়া, বড়দের কাছে সময়ের প্রতিচ্ছবি। বদলে গেছে সময়। বদলে গেছে দিন। বদলে গেছে জীবনযাপনের ধরন। ছড়া সৃষ্টিতে যারা নিবেদিত, তাদের ছড়ায় সময় পরিবর্তনের ইতিবাচক অনুষঙ্গগুলো যদি যথার্থভাবে উঠে আসে তাহলে ছড়া সময়ের প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচিত হবে।
যে যাই বলুক, এ কথা অনস্বীকার্য- ছড়া শুধু ছোটদের নয়, ছড়া বড়দেরও নয়, ছড়া আসলে পাঠকের।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।