সাঈদীর ফাঁসি, চাই নাকি চাই না?
শিরোনামটা পড়ে অনেকে অবাক হতে পারেন। কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক মাত্রই নিশ্চয়ই চায়। না চাইবার তো কোন কারণ নেই। তবু আমার মাথায় প্রশ্ন খেলে যাচ্ছে, আমি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ছি, আমি এই রাজাকারের ফাঁসি চাই নাকি চাই না?
এই দ্বিধার কারণ হচ্ছে পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যৎ এর অনুমান। ইতোপূর্বে ট্রাইব্যুনালের সকল রায় বিশেষতঃ সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর দেশজুড়ে যে নারকীয় তান্ডব হয়েছিল তা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন এখন কিন্তু আমি ভুলিনি। আর তাই দীর্ঘ সময় পর যখন সাঈদীর রায় হবার খবর শুনে রিয়েল এবং ভার্চুয়াল জগতে আশেপাশের সবাই আনন্দের বন্যায় ভাসছেন আর সাঈদীর ফাঁসির দাবীতে আওয়াজ তুলছেন আমি তখনো ভাবছি এই ফাঁসির রায় হলে কি পাবো কি হারাবো?
সত্য হচ্ছে, ৪৩ বছর পর স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার সরকার শুরু করলেও বর্তমানে সেই বিচারের যে বেহাল দশা তাতে সরকারের উপর এই ব্যাপারে আস্থা রাখা যে দুরূহ হয়ে পড়েছে তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন। এই সাঈদীর চূড়ান্ত রায়ই প্রায় পাঁচ মাস ‘যেকোন দিন’ হিসেবে অপেক্ষমান রাখার পর অবশেষে কাল ঘোষিত হবে। যদিও রায় কি হবে তা নিয়ে সন্দেহের ঘোর কাটছে না এখনো। এছাড়া রাজাকারের অসুস্থতার কারণে রায় পিছিয়ে দেওয়া, বয়স বিবেচনা করে রাজাকার শিরোমনিকে সর্বোচ্চ শাস্তি না দেয়া এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রীতার ফসল হিসেবে রাজাকারদের স্বাভাবিক মৃত্যু আমরা দেখেছি। পলাতক বাচ্চু রাজাকারকে ফিরিয়ে আনার কোন কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে দেখা যায়নি সরকারের। উপরন্তু যুদ্ধাপরাধীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সরকারের প্রতিনিয়ত দহরম মহরম চোখে পড়ার মতোই বৈকি। সেক্ষেত্রে সাঈদীর কি রায় ঘোষিত হবে বা ঘোষণা হলেও আদৌ সেই রায় কার্যকর হবে কিনা হলে কবে হবে তা নিয়ে সংশয় থাকছেই।
একদিকে বিচারের যখন এই দীর্ঘসূত্রীতা তখন অন্যদিকে আমরা দেখেছি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের উপর হামলা, তাদের বাড়িঘরে হামলা, স্বজনদের উপর হামলা। শুধু তাই নয়, যেকোন সময় রায় কিংবা অন্য কোন ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের অমুসলিম সকল সম্প্রদায়ের উপর নারকীয় আগ্রাসন চলেছে বেপরোয়াভাবে। রাষ্ট্র যেন নির্বিকার। রাজাকারদের রাষ্ট্রীয় খরচে আপ্যায়ন করে বাঁচিয়ে রাখতে রাষ্ট্র ও সরকার যতটা ব্যতিব্যস্ত ছিল তার সিকিভাগও সজাগ ছিল না এই ভিন্ন ধর্মের মানুষগুলোর জীবন রক্ষায়, অধিকার রক্ষায়। নির্বিচারে এদের ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে, মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে। নিঃস্ব পথের ভিখিরি হয়ে তারা বলেছে এই দেশে আর থাকবো না। সামনে দুর্গাপূজা। প্রতিমা বানানোর কাজ চলছে সারাদেশে জোরেসোরে। ঠিক এই সময় এমন একটি রায়ে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য বেশ পর্যাপ্ত উপকরণ পাবেন এই ধর্ম সন্ত্রাসীরা।
অপ্রিয় হলেও সত্য, অসাম্প্রদায়িকতার মোড়ক লাগানো এই সরকার এই ঘটনাগুলোকে কেবল তাদের নির্বাচনী ইস্যু হিসেবেই ব্যবহার করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্য মন্ত্রী ও নেতারা এসব দেখে চোখের জল নাকের জল এক করেছেন এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুংকার দিয়েছেন। কিন্তু ‘অসারের তর্জন গর্জন সার’। যতটা আবেগময় কথা আমাদের মন্ত্রীরা বলেছেন তার কিয়দংশও বাস্তবে রূপ পায়নি। এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি কোন সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের। শাস্তি হয়নি সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো এসব নরপশুর। ক্ষোভে অভিমানে দেশত্যাগ করে যাওয়া এই ‘সংখ্যালঘু’রা দিন দিন সংখ্যায় আরো লঘু হচ্ছেন এবং এই দেশটাকে শতভাগ মুসলিম এর দেশ বানানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। পথে ঘাটে রাস্তায় চলতে ফিরতে এখন কেউ প্রথমেই ধরে নেয় আমি মুসলিম। পরে নাম শুনে যেন হোঁচট খায়। এই নামের মানুষ বাংলাদেশে কি করে? ভারত যায় না কেন? অর্ধশিক্ষিত ক্লার্ক হোক আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ফিটফাট বাবু, কেউই নামটা ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারবেন না, সঠিক বানানে লিখতে পারবেন না। যেন রাশিয়ান কিংবা জার্মান ভাষার নাম, এদেশের সাথে খাপ খায় না। আরবি কিংবা ফারসি ভাষার ইসতারিফিলুল্লাহ নামটা উচ্চারণ করা গেলেও শুদ্ধ বাংলা ভাষায় শুভ্রা নামটা উচ্চারণ করতে তারা যেন হিমশিম খান। একসময় মনে করতাম তারা বাংলা বুঝেন না। এখন বুঝি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এমন নাম খুবই বেমানান। তাই বাবা বিদেয় হও, এদেশটা ১০০ ভাগ মুসলমানের হইতে দেও।
এই যখন অবস্থা, দেশের এই মানুষগুলো যখন কেবলই পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের ঘুঁটি, এদের যখন রামও মারে, রাবণেও মারে তখন আমি সত্যিই নিজেকে প্রশ্ন করি, সাঈদীর ফাঁসি চাই নাকি চাই না? কারণ যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন যেভাবে এদেশে গেঁড়ে বসেছে তাতে তাদের সমূলে বিনাশ করা সহজ নয়। উলটো দেশপ্রেমিক সরকার যখন তাদের সাথে একের পর এক আপোষ করে যাচ্ছে তখন বলতেই হয় এদেশ থেকে এদের উৎখাত করা অসম্ভবই বটে। তাই দু’চারটা যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের শেষ করা যাবে, যুদ্ধাপরাধীদের মানসিকতাকে শেষ করা যাবে না। নব্য রাজাকারদের বিচারের আওতায় না আনা হলে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন তথা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলবেই। উল্টো লাভ হবে এই, প্রতিবার এসব যুদ্ধাপরাধীর রায়কে কেন্দ্র করে এই দেশের এই নিরীহ মানুষগুলোকে দেশছাড়া করা হবে। এদের আত্মত্যাগের ইতিহাসে সংবিধানে লিখা হবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।
শুভ্রা করএই দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমিও চাই দীর্ঘ ৪৩ বছরের যে দায়, যে কলঙ্ক তা মোচন হোক এদের ফাঁসি দিয়ে। কিন্তু এই পুরনো কলঙ্ক মোচন করতে গিয়ে আমরা যেন নতুন করে আবার কলঙ্কের ভাগীদার না হই। রায় পরবর্তী তান্ডব প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যদি সরকারের না থাকে, সকল নিরাপত্তা বেষ্টনী যদি হয় কেবল রাজধানীকে ঘিরে তবে এই সরকার জনগণের সরকার নয়, সকল মানুষের সরকার নয়। আমি অতীতের কলঙ্কের দায়ভার থেকে মুক্ত হতে চাই নতুন করে কোন কলঙ্কের দায় মাথায় না নিয়েই। আমাদের সরকার, আমাদের রাষ্ট্র কি সে ব্যাপারে সজাগ আছে? নাকি রাত পোহাবার এখনো অনেক দেরী?
লেখক: সম্পাদক, জাগরণীয়া
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।