মারমা জাতিসত্ত্বা এবং জুম্ম জাতীয়তাবাদ
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দিক থেকে চাকমাদের পর পরই মারমাদের অবস্থান। মারমারা মূলত মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। ম্রাইমা শব্দ থেকে মারমা শব্দের উৎপত্তি। মারমা জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট একটি ইতিহাস যদিও খুজে পাওয়া যায়না কিন্তু সর্বজন গৃহিত যেটা- কথিত আছে যে, ১৭৮৪ সালের দিকে বর্মিরাজ ভোদফ্রা নামক ব্যাক্তি আরাকান জয় করলে, আরাকান চিরদিনের জন্য স্বাধীনতা হারায়। এরপর হাজার হাজার মানুষ শরণার্থী হয়ে কক্সবাজার,চট্রগ্রাম,পার্বত্য চট্রগ্রাম ও পটুয়াখালীতে এসে বসতি গড়ে। ১৭৯৭ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। সেই সময়ে হাজার হাজার শরণার্থী দেশান্তরিত হওয়ার সময় রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং কিছু খাদ্যাভাবে মারা যায়। ক্যাপ্টেন কক্স, এসকল শরনার্থীদের, কক্সবাজারে গিয়ে সাহায্য সহযোগীতা প্রদান করার জন্য এগিয়ে আসেন (যার নামানুসারে পরবর্তীতে কক্সবাজার নামকরন করা হয়)। এবং পরবর্তীতে এই শরনার্থীরা এই এলাকায় তথা কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি,চট্রগ্রাম ও পটুয়াখালী জেলায় বসবাস করা শুরু করে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা,আসাম ও অরুনাচল ইত্যাদি এলাকায় মারমারা বসবাস করে । যদিও অনেকে মারমা সম্প্রদায়কে মগ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে কিন্তু মারমারা নিজেদের মগ বলে পরিচয় দিতে অস্বীকার করে। তাদের মতে, মগ বলতে কোন জাতি নেই, এরা আরাকানবাসীদের একটা উচ্ছন্ন দল ছিল যারা মূলত জলদস্যু হিসেবে পরিচিত ছিল। এবং নিজেদের দস্যু খেতাবে পরিচিত হতে তারা খুব ই বিরক্তবোধ করে। আবার অনেকেই রাখাইনদেরকেও মারমাদের সাথে মিলিয়ে ফেলেন যেখানে রাখাইনদের রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র ইতিহাস, সংস্কৃতি- আচার অনুষ্ঠান। পার্বত্য জেলায় চাকমারা যেমন পাহাড়ের উপরে বসবাস করে, মারমারা ঠিক তার উল্টো। বসবাসের জন্য তারা পাহাড়ের নিচে সমতল ভূমিকেই বেছে নেয়। সমতল ভূমিতে তারা শক্ত খুটির উপর মাচার মত করে ঘর বানিয়ে বাস করে। মারমাদের গায়ের রং ফরসা এবং পায়ের গোড়ালি বড়, অপেক্ষাকৃত বেঁটে, চোখের নিচের হাড় সামান্য উঁচু এবং চুল কালো। তাদের চোখ ছোট, নাক চ্যাপ্টা এবং শরীরের রং পীতাভ। বার্মিজদের সাথে তাদের চেহারার বিস্তর মিল খুজে পাওয়া যায়। তারা আরাকানি উপভাষায় কথা বলেন এবং এই ভাষাকে তারা বলেন "মারমাচাঘা"। এটি বৃহত্তর তিব্বতি-বার্মা ভাষার অন্তর্গত বার্মা-আরাকান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। ভাষাটি বার্মিজ ভাষার আদলে লেখা হয়। এতে বর্ণমালা ও গাণিতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। বাংলার ন্যায় ২ টি বর্নঃ স্বরবর্ন ও ব্যাঞ্জন বর্ন রয়েছে।
মারমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনূসারী। এছাড়াও অনেকে প্রকৃতি পূজাতেও বিশ্বাসী। মারমাদের প্রধান উৎসব ও পার্বণগুলো হচ্ছে সাংগ্রাই পোয়ে, ওয়াছো পোয়ে, ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে, কঠিন চীবর দান এবং পইংজ্রা পোয়ে।
সাংগ্রাইঃ
সাংগ্রাই পোয়ে উৎসবটি মূলত বৈসাবি উৎসব। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধাণ ৩টি আদিবাসী সমাজের বর্ষ বরণ উৎসব। এটি তাদের প্রধাণ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি। এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক, বৈসু বা বাইসু , মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত। বৈসাবী নামকরনও করা হয়েছে এই তিনটি জাতির একই উৎসবের তিন নাম এর প্রথম অক্ষর গুলো নিয়ে। বৈ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, সা শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং বি শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো 'বৈসাবি'।
মারমা আদিবাসীরা বর্ষবরণের এই উৎসব কে পালন করেন সাংগ্রাই নামে। এ উৎসব চলে ৪দিন ধরে। মূলত 'সাক্রাই' সাল শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দ এসেছে বলে ধারণা করা হয়। যা বাংলায় 'সংক্রান্তি' বলে পরিচিত। সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিনকে মারমা ভাষায় 'সাংগ্রাই আক্যা' বা 'পাইং দোয়াক'। দ্বিতীয় দিন 'সাংগ্রাই বাক্' এবং তৃতীয় দিন 'সাংগ্রাই আপ্যাইং' নামে পরিচিত। অর্থ্যাত প্রথম দিন হল পুষ্প আহরনের দিন, এই দিনে মারমারা নিজেদের বাড়ি, বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের রাস্তা পরিষ্কার করে এবং সবাই মিলে পবিত্র মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে বিহার পরিষ্কার করে। দ্বিতীয় দিন হল সাংগ্রাইয়ের দিন। এই দিনে খুব ভোর থেকে গ্রামে গ্রামে মারমাদের মধ্যে নিজ নিজ উদ্যেগে ফুল সংগ্রহেরর ধুম পড়ে যায়। যে যত বেশি ফুল সংগ্রহ করে বুদ্ধের কাছে পুস্প পুজা দিতে পারবে সে তত বেশি পূন্য অর্জন করবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। সাংগ্রাইয়ের তিন দিনকে উপলক্ষ করে অনেকে বিহারে গিয়ে তিন দিনের জন্য অষ্টমশীল পালন করে উপাসনা করেন। আবার অনেকে এদিন খুব ভোরে বিহারে গিয়ে বুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে ভিক্ষুদের সবার খাবার দান করেন যাকে বলে 'অংরুং ছোইং'। বিহারে অবস্থানরত ভিক্ষুরা এদিন ধর্ম দেশনা দিয়ে থাকেন। দুপুর গড়ালে ভিক্ষুদের দুপুরের খাবার-এর দানানুষ্ঠান শুরু হয়, এটাকে বলা হয় 'দোয়াইং'। অতঃপর ভিক্ষুদের দোয়াইং গ্রহণ শেষ হলে বিকেলে 'নাইংসা' (সুগন্ধিকাব বিশেষ) এর পানি, ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ স্নান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মারমাগণ সবাই বুদ্ধের ছবি সহকারে নদীর তীরে যান এবং দুধ কিংবা চন্দন কাঠের জল দিয়ে এ ছবিটিকে স্নান করান। তারপর আবার এই ছবিটিকে আগের জায়গায় অর্থাৎ মন্দির বা বাসাবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বৈসাবী উৎসবেরই একটি জনপ্রিয় অংশ হল পানি উৎসব। এ উৎসবে জলপূজা শেষ করে, আদিবাসীরা সবাই সবার দিকে পানি ছুঁড়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন যেন গত বছরের সকল দুঃখ, পাপ ধুয়ে যায়। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়। তা ছাড়া মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়। তৃতীয় দিনটি হল সাংগ্রাই বিদায়ের দিন। এই দিনটি মারমাদের কাছে নতুন বছরের শুরু বলে ধারণা করা হয়। এদিনেও পুষ্পপূজা, খাদ্য দান করা হয়। আবার বিহারে আসা পুণ্যর্থীদের মধ্যে পিঠা বিতরণ করা হয়। গ্রামে গ্রামে প্রতিবেশীদের মধ্যে পিঠা বিনিময় করা হয়। একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।
ওয়াগ্যোয়াইঃ
এই উৎসবটি মূলত মারমাদের পূর্নিমা উৎসব, অনেকে এটাকে প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব বলে থাকেন। মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন তিন মাস ধর্মীয় কাজ (বর্ষা মাস) শেষে প্রবারণা পূর্ণিমা উৎ সব উদযাপন করেথাকেন। গৌতম বুদ্ধের মহা চুলকে পূজা ও উৎসর্গ করার জন্য রং-বেরংয়ের ফানুস উড়িয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মারমা নাটক মঞ্চায়ন, মহারথ, মন্দিরে খাবার ও অর্থ দান এবং বিশেষ প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাদের এ অন্যতম ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করেন। ক্যাংগুলোতে রাতে মোমবাতি প্রজ্জলন, আদিবাসী পল্লীতে বিভিন্ন ধরনের পাহাড়ি পিঠা তৈরি উৎসবে মেতে উঠে মারমা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা। গান বাজনা আর বাহারী পোশাকে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় নেমে এসে এ উৎসবকে বরণ করে নেয়ার জন্য। উপজাতীয় নৃত্যের তালে মোমবাতি জালিয়ে রথ টানায় অংশ নেয় হাজার হাজার মারমা তরুণ-তরুণী। এ সময় ধমীয় পূর্ণতা লাভের আশায় দান করা হয় নগদ অর্থ। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাতে রথটি নদীতে উৎসর্গ করা হয়।
কঠিন চীবর দানঃ
এই অনুষ্ঠানে মূলত পূণ্যের আশায়, বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে ত্রি-চীবর নামে বিশেষ পোষাক দান করা হয়। ত্রি-চীবর হলো চার খণ্ডের পরিধেয় বস্ত্র, যাতে রয়েছে দোয়াজিক, অন্তর্বাস, চীবর ও কটিবন্ধনী। এই পোষাক পরতে দেয়া হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের। এই পোষাক তৈরি করার জন্য প্রস্তুতিস্বরূপ প্রথমে তুলার বীজ বোনা হয়, পরে তুলা সংগ্রহ করা হয়, তা থেকে সুতা কাটা হয়, সেই সুতায় রং করা হয় গাছ-গাছড়ার ছাল বা ফল থেকে তৈরি রং দিয়ে, এবং সবশেষে নানা আচার-অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে মাত্র ২৪ ঘণ্টায়, অর্থাৎ এক দিনের ভিতর তৈরি করা হয় এই ত্রি-চীবর। এই পোষাক বোনায় ব্যবহার করা হয় বেইন বা কাপড় বোনার বাঁশে তৈরি ফ্রেম। এরকম বেইনে একসঙ্গে চারজন কাপড় বুনে থাকেন। এভাবে ২৪ ঘন্টা পর তৈরি হওয়া সেসব পবিত্র চীবর, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হাতে তুলে দেয়া হয় কঠোর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে।
পইংজ্রাঃ
পইংজ্রা তথা রাজপূন্যাহ। এটি মূলত সার্কেল চিফের তথা রাজার বাৎসরিক খাজনা আদায় উৎসব যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় পইংজ্রা। পাহাড়ে জুম উঠে যাওয়ার পর সাধারনত জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসের দিকে জুমচাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হয়। এ সময় রাজার পক্ষ হতে রাজপূন্যাহর আয়োজন করা হয়ে থাকে। রাজা এক ধরনের মেলার/উৎসবের আয়োজন করেন যেখানে প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য থাকে যাত্রা, সার্কাস, বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট নাচ-গান-নাটক, ঐতিহ্যবাহী পণ্যসামগ্রীর মেলাসহ নানা রকমের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। এ উৎসবকে ঘিরে রাজবাড়ীতে সাজ সাজ রব শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে চলে এই অনুষ্ঠান। রাজকীয় সাজসজ্জা আর বিউগলের সুরে মুখরিত থাকে রাজপুণ্যাহর দিনগুলো। রাজা রাজ পোশাক পরে এবং গার্ড অব অর্নার গ্রহনের মাধ্যমে রাজবাড়ী থেকে সৈন্য-সেনা সহ মঞ্চে আসেন। বিভিন্ন মৌজার হেডম্যান-কারবারীগণ রাজপুণ্যাহ তে অংশ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ট্যাক্স রাজার হাতে তুলে দেন।
মারমাদের মধ্যে আবার গৌত্র ভাগ ও রয়েছে আর এই গোত্র গুলো তাদের পূর্ব পুরুষদের বাস স্থানের নামের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। গোত্র গুলো হলঃ রিগো বা খ্যংসা, কক্দাইংসা, মারোসা, ক্যক্ফ্যাসা, ফ্রাংসা, থংসা, প্যালেঙসা, ওয়ইংসা, মুরিখ্যংসা, লংদুসা (গৌত্র সম্পর্কে বিশদ লিখুন)। মারমা ছেলেরা যদিও গোষ্ঠির বাইরে কাউকে বিয়ে করতে চাইতে পারে না কিন্তু মেয়েরা পারে। আর বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের পছন্দকে খুব বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়ে। বরপক্ষ থেকে বিজোড় সংখ্যার লোকজন কনের বাড়িতে গিয়ে এক বোতল মদ কনের মা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়ে তার পছন্দের কথা তার মাকে বলে তারপর কনের মা-বাবা প্রস্তাবের উত্তর দেন । তারা যদি অসম্মতি জানান তাহলে বরপক্ষকে মদের বোতল ফেরৎ দেয়া হয়। আর সম্মতি জানালে কনে পক্ষ থেকে আরো মদের বোতল প্রদান করে উভয় পক্ষ হাসি তামাসা করে মদ পান করে। পরে কনের বাড়ি থেকে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া লোকগুলো ফিরে বরের মা- বাবাকে যদি বিয়েতে কন্যাপক্ষ রাজি বলে জানিয়ে দেয় তবে সমাজ ডেকে বিয়ের দুই দিন আগে বর কনের মঙ্গল কামনা করে চুং-মংলেহ পূজা করে বিয়ে করিয়ে দেয়া হয় ।
চুং-মংলেহ পূজায় দেবতার উদ্দেশ্যে একটি শুকর ও পাঁচটি মুরগী বলি দেয়া হয়। বিয়ের নির্ধারিত দিনে পাত্রের বাড়ীর প্রবেশ দ্বারে কলা গাছের দু’টি কচি চারা বসিয়ে তার পাশে সাদা সুতো দিয়ে পেচানো দুটো পানি পূর্ণ কলস এবং বিন্নি চাউল থেকে তৈরী পানীয় (দো-চুয়ানী) রাখা হয়। বউ আনতে যাবার দিনে একটি সেদ্ধ মোরগ, চিংরে (মদ তৈরির হবার পূর্বে ভাত, পানি ও মুলির সংমিশ্রণ) এক বোতল, মদ এক বোতল, একটি থ্বিং (মারমা মেয়েদের নিম্নাংশের পরিধেয় কাপড়) একটি বেদাই আংগি (উর্ধাঙ্গের পোশাক), একটি রাংগাই আংগি (বক্ষবন্ধনী), ১ জোড়া কাখ্যাং (পায়ের খারু) একটি গ্বং (মাথার বন্ধনী) নিয়ে পাত্রের মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধবসহ বাদ্য-বাজনা সহকারে কনের বাড়িতে যান। বরপক্ষ কনে নিয়ে ফিরে যাবার পথে কনের সমবয়সী ও বন্ধু-বান্ধবীরা বাঁশ ফেলে পথরোধ করে। এ সময় তাদের দাবী অনুসারে মদ ও নগদ অর্থ উপহার দিয়ে কনে নিয়ে যেতে হয়। বিবাহের মূল অনুষ্ঠানটি ‘উবদিদাই’ বা ‘ম্তে ছ্রা/আখা ছড়া’ (বিবাহের মন্ত্র জানা ব্যক্তি) দ্বারা বরের বাড়ীতে পরিচালিত হয়। তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানে মন্ত্রপূত জলপূর্ণ পাত্রে এক গুচ্ছ জামের কচি পাতা ডুবিয়ে তা দিয়ে বর ও কনের মাথায় পাঁচ-সাতবার পবিত্র জল ছিটিয়ে দেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের মূল পর্বে কনের ডানহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলের সাথে বরের বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলটি যুক্ত করে তাতে পবিত্র জল ছিটিয়ে দেয়া হয়। এ অনুষ্ঠানকে মারমা ভাষায় ‘লাক্ থেক্ পোই’ বলে। আর এই ‘লাক্ থেক্ পোই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহকে সমাজসিদ্ধ করা হয়।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল, যদিও মারমারা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এছাড়াও তারা প্রকৃতিরও পূজা করে। যার উল্লেখযোগ্য উদাহরন হল জাম পাতা ও জাম শাখার ব্যবহার। বিয়ে ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, নতুন ঘর তৈরির পর মঙ্গলঘট সাজানোতে জাম পাতা ও শাখার প্রয়োজন হয়। মারমারা অশ্বথ গাছকে পবিত্রতা ও শান্তির প্রতীক বলে মনে করেন। রোয়াতাংনাইক্/রোওয়াশ্যাংমা হলেন তাদের পাড়া রক্ষাকারী দেবী। প্রতিটি পাড়ার প্রবেশ পথের পাশে বুনো চাঁপা গাছের নিচে অথবা যে কোনো দীর্ঘজীবি বৃক্ষের নীচে রোওয়াশ্যাংমা দেবীর জন্য মাচার ঘর তৈরি করে মাচা সহ গাছটিকে ঘিরে রাখা হয়। সে মাচা ঘরে পাড়া রক্ষী দেবী থাকেন বলে বিশ্বাস করা হয়। সেই গাছের অনিষ্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, এ গাছের একটি পাতা ছিড়লেও অমঙ্গল হয়। অন্ততঃ বছরে একবার এই দেবীর পূজা দেয়া হয়। আর একজন দেবী হলেন খ্যংশ্যাংমা। তিনি মূলত জলরক্ষী দেবী। তিনি পরাক্রমী, বিক্রমশালী দেবী। মারমারা মনে করেন, জগতে পাঁচ প্রকার বিপদ, যার মধ্যে আছে- অগ্নি, জল, খরা, বর্ষা ও বজ্রপাত। এসব হতে রক্ষা পাবার প্রয়োজনে খ্যংশ্যাংমা দেবীকে পুজা করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার রোগ-ব্যাধি, মন্দ আত্মা, ভূত, প্রেতের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতেও খ্যংশ্যাংমা দেবীর পুজা হয়। মারমা জনগোষ্ঠী জন্মান্তরবাদ ও জ্যোতিষতত্ত্বে প্রচন্ড ভাবে বিশ্বাস করে। কোন সন্তান জন্ম নিলে তারা মনে করেন যে তাদের পূর্ব পুরুষদের কেউ না কেউ আবারো জন্ম গ্রহন করেছেন। আর তাই নবজাতকের নামকরন পূর্ব পুরুষের নামের আদলে করা হয়। মারমা পরিবারে জন্ম নেয়া প্রথম সন্তানের নামকরণের সময় অনেক পরিবার শিশুর নামের প্রথম অক্ষর হিসেবে ‘উ’ যুক্ত করে, যেমনঃ উমংপ্রু মারমা। আবার সন্তান যদি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ হয়, তাহলে তার নামের শেষে ‘থুই’ যুক্ত হয়, যেমনঃ অংসাথুই মারমা ইত্যাদি। যদিও পূর্ববর্তী আলোচনায় বলা হয়েছে যে, মারমা সম্প্রদায় পিতৃতান্ত্রিক তথাপি মারমা নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে। জুম চাষ থেকে শুরু করে সংসারের সকল কাজই তারা করে থাকেন, তারা পুরুষদের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রমী। আর এ কারনেই মারমা সমাজে নারীর সম্মান অনেক বেশি। সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভের ক্ষেত্রে এই নারীরা পিতার সম্পত্তির এক চতুর্থাংশের দাবীদার। অর্থ্যাত পিতার সম্পত্তির তিন চতুর্থাংশের মালিকানা লাভ করে পুত্র সন্তানগন আর এক চতুর্থাংশ পায় স্ত্রী এবং কন্যা সন্তান গন। যদিও মারমাদের তথা পার্বত্য এই অঞ্চলের জুমিয়া মানুষদের ভূমির উপর মালিকানা সেভাবে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যকর না হওয়ায় আর পাকিস্তান বা বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সচেতন না করায় পাহাড়িদের কেউই জমি জমার দলিলপত্র বা বন্দোবস্ত প্রথার বিষয়ে জানতেই পারেনি। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে (সিএস) না হওয়ার ফলে পাহাড়িদের ভূমির ওপর মালিকানা নির্ধারণে জটিলতা ছিলই। তার ওপর ১৮৮৫ সালে যখন জমিদারি প্রথা বিলোপ করে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করা হয় তখনো উদ্দেশ্যমূলকভাবে পার্বত্য অঞ্চলকে এ আইনের আওতায় আনা হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৫০ সালে নতুন করে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করা হলেও তাতে আদিবাসীদের সম্পত্তির অধিকারের বিষয় স্থান পায়নি। সর্বোপরি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ দেশীয় শিক্ষার মানদণ্ডে শিক্ষিত না হওয়ায় এবং রাজতন্ত্রের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থা চালু থাকায় যে জমিতে পাহাড়িরা বসবাস করছে, সেই জমি সরকারের কাছে খাস জমি হিসেবে গণ্য হয়। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সম্পত্তির অধিকার-সংক্রান্ত যে ধারণা, তা সমতলের বাঙালির চেয়ে ভিন্ন হওয়ায় জটিলতা আরো তীব্র হয়েছে। একক সম্পত্তির অধিকারের পরিবর্তে আদিবাসীরা সমষ্টিগত সম্পত্তির অধিকারে বিশ্বাসী ছিল, যা কোন এককে বিভক্ত করা যায় না। কিন্তু দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা কিংবা মালিকানা নির্ধারণের আইনগুলোয় আদিবাসীদের এরূপ সম্পত্তির অধিকারের কোনো স্বীকৃতি নেই। তাই জোরপূর্বক আদিবাসীদের জায়গায় বাঙালি সেটেলার বসানো সম্ভব হয়েছে। যে জমিটি আদিবাসীরা বংশপরম্পরায় ভোগ করে আসছে, রাজাকে খাজনা দিয়ে যাচ্ছে, সেই জমিটি এক মুহূর্তে কোনো এক বাঙালির হয়ে যেতে পেরেছে।
ঐহিত্যগত ভাবে মারমা সমাজ ব্যবস্হাপনাকে গ্রাম, মৌজা ও সার্কেল এই তিন পর্যায়ে ভাগ করে পরিচালনা করা হয়। গ্রাম পরিচালনায় প্রধান হচ্ছেন "কারবারী"। মৌজা পর্যায়ে "হেডম্যান" এবং সার্কেল প্রধান হচ্ছে রাজা । ১৮৮৪ সনের আঞ্চলিক সার্কেল বিধির আওতায় (Rules for Territorial Circles in the Chittagong Hill Tracts, 1884) তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকেঃ
(১) রাজা হরিশ্চন্দ্রের সার্কেল
(২) মং রাজার সার্কেল
(৩) বোমাং সার্কেল
(৪) সদর সাব ডিভিশনাল খাসমহাল
(৫) সাঙ্গু সাব ডিভিশনাল খাসমহাল
মোট ৫টি সার্কেলে ভাগ করা হয়। উল্লিখিত আঞ্চলিক সার্কেল বিধি দ্বারা তিন রাজার (পূর্ববর্তী রাজাদের বহাল রেখেই) তিনটি সার্কেলের (রাজা হরিশ্চন্দ্রের সার্কেল, মং রাজার সার্কেল, বোমাং সার্কেল) সীমানা নির্ধারণ করে দেয় বৃটিশ সরকার। পরবর্তীতে ১৮৮৪ সনের আঞ্চলিক সার্কেল বিধি সংশোধন ও পরিবর্তন করে ১৮৯২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পূর্বের তিনজন চীফের (রাজা) তিনটি সার্কেল (রাজ্য) বহাল রেখে সরকারী সংরক্ষিত বনাঞ্চলহসমূহ নামে আরও একটি সার্কেল গঠন করে মোট ৪টি সার্কেলে ভাগ করা হয়। এবং একই সাথে জেলার শাসন কাজ পরিচালনার জন্য বৃটিশ সরকার মোট ১৭টি বিধি সম্বলিত "Rules for the Administration of the Chittagong Hill Tracts"নামে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে। উক্ত বিধিমালার ৩নং বিধি দ্বারা সমগ্র জেলাকে মোট ৩৩টি ব্লক বা তালুকে বিভক্ত করা হয়। এবং ১.৫ বর্গমাইল থেকে ২০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে এক একটি মৌজা গঠন করার ব্যবস্থা করা হয়। প্রত্যেক তালুকে একজন দেওয়ান নিয়োগ ও তালুকসমূহকে মৌজায় বিভক্ত করে মৌজা হেডম্যান নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয় একই সাথে তালুক দেওয়ান ও মৌজা হেডম্যানগণের প্রশাসনিক ক্ষমতাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ১৯০০ সালে সরকার Rules for the Administration of the Chittagong Hill Tracts সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন (Regulation 1 of 1900) নামের একটি আইন জারী করেন, যা স্থানীয়ভাবে Hill Tracts Manual নামে পরিচিত যেখানে ‘দেওয়ান’ পদটি বিলুপ্ত করা হয় এবং সার্কেল চীফ ও মৌজা হেডম্যানকে আদিবাসীদের সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তির কিছু বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হয়। উপরে উল্লেখিত সার্কেলে, মারমাদের দুটি সার্কেল বিদ্যমান। একটি মং সার্কেল ও অন্যটি বোমাং সার্কেল। মং সার্কেলটি পুরো খাগড়াছড়ি জুড়ে বিস্তৃত হলেও, বোমাং সার্কেল বান্দরবান জেলার ৯৫টি মৌজা এবং রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার ৯টি ও কাপ্তাই উপজেলার ৫টি মৌজাসহ মোট ১০৯টি মৌজা নিয়ে গঠিত। সার্কেল গুলোর রাজা গন তাদের প্রজাদের কাছে রাজা নামে পরিচিত হলেও কাগজে কলমে সরকারী ভাবে এখন পর্যন্ত সার্কেল চিফ নামেই পরিচিত। চাকমা ও মং সার্কেল চীফ (রাজা) পদের ক্ষেত্রে রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা হবেন এবং রাজার একাধিক স্ত্রীর বেলায় প্রথম স্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজপদ লাভ করেন। রাজার ঔরসজাত কোনো পুত্র সন্তান না থাকলে, সেক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কন্যার পুত্র রাজা হবেন। তবে মং সার্কেল চীফের বেলায় ঔরসজাত পুত্র-কন্যার অবর্তমানে দত্তক পুত্রের বা কন্যার বেলায় রাজপদ উত্তরাধিকারযোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে মং সার্কেল চীফের ঔরসজাত পুত্র-কন্যার অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী (রাণী) অতঃপর পিতৃ/মাতৃকুলের রক্ত সম্পর্কীয় কোনো যোগ্য ব্যক্তি প্রচলিত রীতি ও সমাজ স্বীকৃত প্রথা অনুসারে মং সার্কেল চীফ পদে অধিষ্ঠিত হবেন। বোমাং সার্কেলের প্রচলিত রীতি ও সমাজ স্বীকৃত প্রথা অনুযায়ী বোমাং রাজ পরিবারের পিতৃ/মাতৃকুলে যিনি সর্ব বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তিনি বোমাং সার্কেল চীফ হবেন। যদি সর্ব বয়োজ্যেষ্ঠ সেই ব্যক্তি বোমাং সার্কেলের চীফ পদ গ্রহণে অসম্মতি জ্ঞাপন না করেন, সেক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বোমাং সার্কেলের মারমা সমাজে প্রচলিত নীতি ও সমাজ স্বীকৃত সার্কেল চীফ নিয়োগ পদ্ধতি অনুযায়ী তাঁকে সার্কেল চীফ পদে নিয়োগ দান করবেন। এই রাজাদের শাসন ব্যবস্থা যতটা না বাস্তবিক, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতীকী। প্রতীকী এই অর্থে যে, রাজা হলেও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির আওতায় (যেটি কিনা বর্তমান পর্যন্ত কার্যকর) একজন রাজার সেভাবে প্রশাসনিক কোন ক্ষমতা নেই, শুধু নামের রাজা। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে সরকারের পক্ষে ট্যাক্স আদায় করা আর পাহাড়ী জনগোষ্ঠীগুলোর সামাজিক বিচার-শালিস করার দায়িত্ব তাদের। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই রাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা যেন ফিকে হয়ে এসেছে। প্রতিটি মৌজায় একজন করে সার্কেল চিফের তথা রাজার প্রতিনিধি আছেন যিনি প্রশাসনিকভাবে হেডম্যান হিসেবে পরিচিত। সার্কেল প্রধানের (রাজা) সাথে পরামর্শ করে জেলা প্রশাসক হেডম্যানদের নিয়োগ দেন। পাড়া (গ্রাম) গুলোতে থাকেন একজন করে কারবারী যারা ট্যাক্স আদায় এবং সামাজিক বিচার-শালিসে হেডম্যানকে সহায়তা করেন। কোনো বিচার বা শালিসের বিষয়ে হেডম্যান সমাধান দিতে অপারগ হলে সার্কেল চিফ তার সমাধান দিয়ে থাকেন।
রাজপূন্যাহ মূলত হচ্ছে সার্কেল চিফের তথা রাজার বাৎসরিক খাজনা আদায় উৎসব যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় পইংজ্রা। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৫ম বোমাং রাজা সাক হ্ন ঞো প্রথম রাজপুণ্যাহর আয়োজন করেন। পাহাড়ে জুম উঠে যাওয়ার পর সাধারনত জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসের দিকে জুমচাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হয়। এ সময় রাজার পক্ষ হতে রাজপূন্যাহর আয়োজন করা হয়ে থাকে। রাজা এক ধরনের মেলার/উৎসবের আয়োজন করেন যেখানে প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য থাকে যাত্রা, সার্কাস, বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট নাচ-গান-নাটক, ঐতিহ্যবাহী পণ্যসামগ্রীর মেলাসহ নানা রকমের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। এ উৎসবকে ঘিরে রাজবাড়ীতে সাজ সাজ রব শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে চলে এই অনুষ্ঠান। রাজকীয় সাজসজ্জা আর বিউগলের সুরে মুখরিত থাকে রাজপুণ্যাহর দিনগুলো। রাজা রাজ পোশাক পরে এবং গার্ড অব অর্নার গ্রহনের মাধ্যমে রাজবাড়ী থেকে সৈন্য-সেনা সহ মঞ্চে আসেন। বিভিন্ন মৌজার হেডম্যান-কারবারীগণ রাজপুণ্যাহ তে অংশ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ট্যাক্স রাজার হাতে তুলে দেন। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি অনুযায়ী প্রতিটি জুমিয়া পরিবারকে জুম ট্যাক্স হিসেবে এক বছরের জন্য ৬ টাকা করে প্রদান করতে হয়। এই ৬ টাকা হতে বোমাং রাজা ২.৫০ টাকা গ্রহন করেন, হেডম্যান গ্রহন করে ২.২৫ টাকা এবং বাকী টাকা চলে যায় সরকারী রাজস্বে। আধুনিক যুগে ফিকে হয়ে আসা এই রাজতন্ত্রের রাজাদের মূলত ট্যাক্স আদায় আর বিচার-শালিস ছাড়া তাদের রাজত্বে তেমন কোন ভূমিকা নেই। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি অনুযায়ী এই রাজাকে 'সার্কেল চিফ' হিসেবে জেলার ডেপুটি কমিশনারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন তথা সাব-কালেক্টর বা সরকারের খাজনা আদায়কারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খাজনা আদায় ও এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখাসহ অপরাধ দমনে মৌজা হেডম্যানদের প্রতি আদেশ- নির্দেশ ও পরামর্শ প্রদান, আদায়কৃত খাজনা সরকারী কোষাগারে জমাদান নিশ্চিত করন, এলাকার জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার, নিজ সার্কেলের অধীন মৌজাসমূহে ডেপুটি কমিশনারের আদেশ নির্দেশ কার্যকরীকরণ ইত্যাদি কর্মকান্ড তাকে পালন করতে হয়। ১৮৯২ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে মৌজা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। যেখানে ৩৩টি তালুককে ১.৫ থেকে ২০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে মৌজায় বিভক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিতে (হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েল) তিনজন রাজার ৩টি সার্কেলকে মৌজায় বিভক্ত করার পুনঃবিধান করা হয় এবং প্রত্যেক মৌজায় ১ জন করে মৌজা হেডম্যান নিয়োগের বিধান রাখা হয়। এই বিধি মতে, সার্কেল চীফের (রাজা) সাথে পরামর্শ করে ডেপুটি কমিশনার মৌজা হেডম্যান নিয়োগ করেন। সার্কেল চীফ তথা রাজার মত হেডম্যান নামক এই পদটি বংশানুক্রমিক নয় তবে হেডম্যানের উপযুক্ত পুত্র হেডম্যান পদে নিয়োগ লাভের বেলায় অগ্রাধিকারের দাবী রাখেন। উক্ত বিধি অনুযায়ী একজন হেডম্যান তাঁর মৌজায় নিম্নোক্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেনঃ
১। জুমিয়া জমির মালিকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়
২।ডেপুটি কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সার্কেল চীফের আদেশ মেনে চলা
৩। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা
৪। মৌজায় চাষাবাদের আওতাধীন এলাকার (আয়তনের) কোনো পরিবর্তন ঘটলে তৎসম্পর্কে ডেপুটি কমিশনারকে অবহিত করা
৫। জুম চাষ নিয়ন্ত্রণ করা
৬। জুম তৌজি তথা জুমিয়ার তালিকা প্রস্তুত করা
৭। জুম খাজনা প্রদান থেকে রেহাই পাবার জন্য অন্যত্র পালিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়া প্রজার সম্পত্তি আটক
৮। মৌজার প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষন
৯। সরকারী ভূমি বন্দোবস্ত, হস্তান্তর, ভাগ-বন্টন এবং পুনঃ ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে সুপারিশ প্রদান
উপরোক্ত দায়িত্ব ছাড়াও উক্ত বিধি হেডম্যানকে কিছু বিচারিক ক্ষমতাও প্রদান করে। এবং একটা বিচারকার্যে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন ও দোষী ব্যাক্তিকে ৫০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন এছাড়া জেলা প্রশাসকের আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত দোষী ব্যক্তিকে আটক রাখবার আদেশ দিতে পারবেন। একজন হেডম্যানের উপরে বর্নিত বিচারিক ক্ষমতা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে, হেডম্যান গন বিচার কার্য নামক বিষয়টিকে এড়িয়েই চলেন। বরং এই কাজ গুলা তথা বিচার, মিমাংসা, সালিশ, গোত্র/পাড়া পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহন ইত্যাদি কারবারীদের হাতে ন্যাস্ত হয়ে গেছে। গঠিত হয়েছে কারবারী আদালত।
মারমা সম্প্রদায়ে কারবারী বলতে মূলত গ্রাম প্রধান তথা মারমাদের স্থানীয় চিফকে বোঝায়। ফ্রান্সিস বুকানন তার ভ্রমণ ডাইরীতে এই কারবারীকে, রুয়া-সা (Rua-sa) তথা মারমাদের স্থানীয় চীফ, যার বর্মী নাম য়্য-সা, আরাকানী নাম য়্যন্সা এবং বাংলায় বিকৃত শব্দ রোয়াজা বলে উল্লেখ করেন। কারবারী নামক এই গ্রাম প্রধানের অস্তিত্বের কথা সর্ব প্রথম উঠে আসে নতুন সৃষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সুপারিনটেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন জে.এম. গ্রাহামের ১৮ই নভেম্বর, ১৮৬২ তারিখের এক পত্রে। আবার ক্যাপ্টেন টি.এইচ. লুইনের ১৮৬৭ সালের অন্য আরেকটি প্রতিবেদনেও এই কারবারী নামটি উঠে আসে। অর্থ্যাত আমরা যদি মারমা সমাজে এই কারবারী নামক প্রপঞ্চটির ইতিহাসের দিকে তাকাতে যাই তবে কারবারী নামক এই সম্প্রয়দায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি হেডম্যানের মত করে নতুন হঠ্যাৎ তৈরি হয়ে যাওয়া কোন স্বত্ত্বা নয় বরং এর ইতিহাস অনেক সুদূর প্রসারী। সুদূর অতীতে পাড়া গুলোতে রাজারা, এই রোয়াজা তথা কারবারী নিয়োগ দিতেন। এবং সে সময় এই রোয়াজারাই ছিলেন গ্রাম প্রধান। তিনি রাজার হয়ে, প্রজাদের নিকট হতে রাজস্ব আদায় করতেন। প্রজাদের সকল ধরনের বিচার-আচার, ভাল-মন্দ, দুঃখ-দুর্দশা, শাস্তি-বিধান, আইন-কানুন, ধর্ম-আচার সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত ছিল তার হাতে। কিন্তু কালের আবর্তে রাজাদের সাথে সাথে, এই কারবারীদের ক্ষমতাও কমে যেতে শুরু করে। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৮ বিধিতে কারবারী নিয়োগ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট কোনো বিবরণ না থাকলেও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৬৬(১) ধারাতে কারবারী পদের স্বীকৃতি রয়েছে। পার্বত্য জেলাসমূহের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সামাজিক সমস্যা, নারীঘটিত কোনো সামাজিক মোকদ্দমার উদ্ভব হলে তা নিষ্পত্তির প্রাথমিক দায়িত্ব কার্বারীর উপর বর্তায়। প্রথম দিকে অর্থ্যাত ব্রিটিশ পিরিয়ডে কারবারীরা সরকার হতে কোন ধরনের ভাতা না পেলেও বর্তমানে তারা সরকার হতে ভাতা পান। যদিও কারবারী নিয়োগের নিয়ম হল, পাড়া গুলোতে রাজা অথবা হেডম্যান এই কারবারী নিয়োগ দেবেন কিন্তু সমসাময়িক সময়ে এই পদটি হয়ে উঠেছে বংশানুক্রমিক। অর্থ্যাত কারবারীর বড় ছেলেই হয়ে উঠেন কারবারী। কারবারী তার গ্রাম তথা পাড়ার দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সামাজিক সমস্যা ইত্যাদির সমাধান করেন তার কারবারী আদালতে। এছাড়াও পাড়ার পূজা-অর্চনা, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহন, আদেশ- পরামর্শ প্রদান ও তিনি করে থাকেন। কারবারী আদালতে বিচার প্রক্রিয়া হয় মূলত শালিসী বোর্ড গঠনের মাধ্যমে। যেই বোর্ডে অন্য দুই/ তিন পাড়ার কারবারীরা উপস্থিত থাকেন, মাঝে মাঝে হেডম্যান অথবা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার (বাধ্যতামূলক নয়) উপস্থিত থাকেন এবং গ্রামের কিছু গন্যমান্য পুরুষ, মহিলা এবং যুবক, যুবতী অংশগ্রহন করেন। বাদী এবং বিবাদী উভয়ই উপস্থিত থাকেন। বাদী-বিবাদী উভয়ের কথা শোনা হয়, স্বাক্ষ্য গ্রহন করা হয়। রায় ঘোষনার ক্ষেত্রে বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্য যে রায় দেন তাই ঘোষনা করেন কারবারী, একা একা কোন রায় দেন না। কারবারী আদালতে বিচার/শালিস/ মিমাংসা শুরুর আগে একটা সাদা কাগজে বাদী, বিবাদী/অভিযুক্তের এই মর্মে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়া হয় যে, বিচারে যেই রায় ই ঘোষনা করা হোক না কেন তা তারা সকলেই মেনে নিতে বাধ্য থাকিবে। পরবর্তীতে আবার এই কাগজেই বিচারের ফলাফল লেখা হয়। প্রমান হিসেবে কারবারী এই কাগজটি তার নিকট সংরক্ষন করেন। বিচার-শালিসের ইস্যু যদি খুব বেশি জটিল হয় অথবা পাড়ার কেউ যদি কারবারী আদালতের সিদ্ধান্তকে মেনে না নিতে চায় তবে সে ইউনিয়ন পরিষদের স্মরনাপন্ন হতে পারে। পাড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকা তথা কোন ধরনের অশান্তি, উত্তেজনা, বিবাদ-কলহের সৃষ্টি না হওয়ার জন্য কারবারী তার গ্রামের গন্যমান্য ব্যাক্তিদের সমন্বয়ে তৈরি করেন পাড়ার চমৎকার কিছু নিয়ম নীতি, আইন কানুন। এসব নিয়ম কানুনের মধ্যে একটা হল নিষেধাজ্ঞা। রাত ৮ টার পর হতে সূর্যোদয় পর্যন্ত কোন দম্পতি কোন ধরনের ঝগড়া কলহে লিপ্ত হতে পারবে না। হলে তাদেরকে কারবারী আদালতে তৎক্ষণাৎ নিয়ে আসা হবে এবং পূর্ব নির্ধারিত শাস্তি হল ছোট্ট একটা চা চামুচ দিয়ে কূপ হতে এক চামুচ করে পানি নিয়ে এসে একটা খালি কলস ভর্তি করা, অথবা ছোট একটা কলসীতে এক কলস করে পানি কূপ হতে নিয়ে পাহাড়ের উপরে মন্দিরে রাখা বড় একটা জার ভর্তি করা। এসব নিয়ম কানুন ছাড়াও রয়েছে মদ খেয়ে মাতলামী না করার নিয়ম কানুন, পাড়ায় যুব কমিটি তৈরি করে তাদের দিয়ে পাড়ার শান্তি শৃংখলা রক্ষার কাজ পরিচালনা এবং অন্য যুবক-যুবতীদের আইন শেখানো ইত্যাদি ইত্যাদি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির এই সব মানুষেরা বাঙ্গালীদেরকে ‘সেটেলার’ হিসেবে সম্বোধন এবং নিজেদের ‘আদীবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ‘সেটেলার’ শব্দটির পারিভাষিক অর্থ হল ঊপনিবেশকারী, যেখানে একজন ঊপনিবেশকারীর মূল লক্ষ্য থাকে সেই নির্দিষ্ট ভূখন্ডে গিয়ে অন্য ঊপনিবেশকারীর সাথে ঘর তৈরি, ব্যবসা দাড় করানো, জমি দাবী করা এবং সর্বোপরী নতুন একটা শহর তৈরি। পাহাড়ে বাঙ্গালীদের এই ‘সেটেলমেন্টের’ ইতিহাস খুব বেশি পুরান নয়। পার্বত্যবাসীর সহজ-সরল জীবন যাত্রায় অন্য কেউ যেন ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ব্রিটিশ সরকার তৈরি করেছিলেন CHT REGULATION ,1900 Act। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন হতে মুক্ত হয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হয়। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণরূপে পূর্ব পাকিস্তানের উপর নিরভরশীল’ এই যুক্তি দ্বার করিয়ে রেডক্লিফ কমিশন, চাকমা রাজা দ্বারা শাসিত স্বায়ত্ব শাসিত অঞ্চলকে যুক্ত করে পাকিস্তানের সাথে। আর সেই থেকে শুরু পার্বত্য এলাকায় বাঙ্গালীদের অবাধ অনুপ্রবেশ । ১৯৪৭ এর আগে যে পার্বত্য এলাকায় বাঙ্গালী বাস করত না বিষয়টা তেমন নয়, তবে সংখ্যায় তারা খুব ই অল্প ছিল। আর তারা সেখানে বসবাস করত চাকুরী অথবা ব্যবসার খাতিরে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পার্বত্য এই অঞ্চলে ধীরে ধীরে বাঙ্গালী প্রবেশ করাতে থাকে। ১৯৬১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী পার্বত্য এই জেলায় পাহাড়ী- বাঙ্গালীর শতকরা হার ৮৮.২৩% (পাহাড়ি)-১১.৭৭% (বাঙালি ) এ গিয়ে দাঁড়ায়। যেটা ১৯৪১ সালে ছিল-পাহাড়ি ৯৭.০৬% এবং বাঙালি ০২.৯৪% (Bangladesh Buearu of Stastic)। আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ণে, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কার্য শুরু হয় ও ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে। এই বাধ নির্মানের ফলে প্রায় ৪০% ভাগ চাষযোগ্য জমি প্লাবিত হয় (৫৪০০০ একর চাষের জমিসহ প্রায় ৪০০ বর্গমাইল এলাকা)। প্রায় চল্লিশ হাজারের ও অধিক চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে এবং ৩০ হাজারের মত মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বার্মায় (মিয়ানমার) স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭১ এ পাকিস্তান হতে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ জন্মলাভ করার পরও থেমে থাকেনি পাহাড়ে বাঙ্গালী ‘সেটেলমেন্ট’। ভারতীয় সেনাদের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও সেই অঞ্চলে থেকে যাওয়াটাও বাড়তি একটা টেনশন তৈরি করছিল।
১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার ৩০ হাজার বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন এবং এর জন্য ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। পাহাড়ে শুরু হয় পাহাড়ী বাঙ্গালী উত্তেজনা। সেই উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষে সেনা মোতায়েন করা হয় আর একই সাথে গড়ে তোলা হয় আনসার ভিডিপি বাহিনী। চট্টগ্রাম এলাকা বাংলাদেশ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সেই ভয় থেকে বিদ্রোহী দমনের জন্য এরশাদ সরকার পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনীর শক্তি আরও বৃদ্ধি করা শুরু করেন। এবং একই সাথে ‘বাঙ্গালীদের’ প্রবেশ তো ছিলই।
জুমিয়া মানুষদের মধ্যে প্রথম ক্ষোভের শুরুটা হয় ১৯৬০ সালের দিকে যখন কাপ্তাই বাঁধ নির্মান হয় এবং প্রায় এক লাখের মত মানুষ উদ্বাস্তু হয় আর প্রচুর পরিমান জমি প্লাবিত হয়। মূলত এই সময়েই এই এলাকার মানুষেরা নিজেদের ‘পাহাড়ী ছাত্র সংঘ’ এবং ‘পার্বত্য উপজাতীয় কল্যান সমিতি’র ব্যানারে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে একত্রিত হতে শুরু করে। মানবেন্দ্র লারমা পাহাড়ীদের ভিটে-মাটি ডুবিয়ে দেয়ার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র অনুধাবন করতে সক্ষম হন। তাই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রয়ারী পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী লারমাকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ লারমা জেল থেকে মুক্তি পান। কারাগারে আটক অবস্থায় লারমা বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭০ সালে তরুণ লারমা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এভাবে তিনি পার্বত্য অঞ্চলের নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়ক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তিনি ছিলেন মার্ক্সবাদী দর্শনের ধারক ও বাহক। শ্রমিক, মেহনতি জনতা ও নিপীড়িত জাতিসমূহের অধিকারের পক্ষে সর্বদা ছিলেন সোচ্চার।
১৯৭১ এ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসানের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশের অন্তর্ভূক্ত হয়। নতুন এই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জুমিয়াদের উপর প্রথম প্রতিঘাতটি আসে যখন নব্য স্বাধীন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী পাহাড়িদেরকে তাদের নিজস্ব জাতীয়তা ভূলে গিয়ে বাঙ্গালী হতে বলে আর পার্বত্য এলাকায় তিনটি সেনা ক্যাম্পের স্থাপনা। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ৪টি দাবী উত্থাপন করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম গণপরিষদ সদস্য চারু বিকাশ চাকমা এবং মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাঃ
১. পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ১৯০০ সালের ম্যানুয়েল বহাল রাখা
৩. তিন জাতির চীফের দপ্তর অব্যাহত রাখা
৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি আবাদিদের অনুপ্রবেশ রোধ করা।
যদিও সংবিধান তাদের জাতিতাত্ত্বিক পরিচিতিকে সে সময় স্বীকৃতি প্রদান করে তথাপি মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা এবং অন্যান্যরা পার্বত্য এলাকায় সার্বভৌমতা এবং বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্নতা দাবী করে বসেন। চারু বিকাশ চাকমা এবং মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা যে চারটি দাবী সংবিধানে অন্তর্ভূক্তির জন্য দাবী করেছিলেন তা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রত্যাক্ষ্যাত হয়। অন্যদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের, জুমিয়াদেরকে বাঙ্গালী হয়ে যাবার আহবান একভাবে তাদের মধ্যে নতুন এক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। যার ফলাফল হিসেবে ১৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ ( পি সি জে এস এস ) নামে একটা রাজনৈতিক দলের উত্থান হয়। যার মূল নীতি ছিল ‘মানবতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, গনতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং অধিকারের সংরক্ষন, সংস্কৃতি ও জাতিগত পরিচয় এবং পার্বত্য অঞ্চলের স্বায়ত্ত্ব শাসন’। একই সাথে এই সংগঠনটি পার্বত্য অঞ্চলের সকল গোত্রের গ্রাম কমিটি, সকল ছাত্র, যুব, নারীদের সংগঠনের আলাদা আলাদা উইং এর আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকে। ঠিক এক বছর পরই অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারী খাগড়াছড়ির ইটছড়ির জঙ্গলে এই দলের শাখা ‘শান্তি বাহিনী’র গঠন হয়। শান্তি বাহিনীর নামকরনের পেছনে সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য মত হচ্ছে, এটি এমএন লারমার ভাই শন্তু লারমার নামের রথম অংশ ‘শন্তু’ তথা ‘শান্তি’ থেকে করা হয়েছে। আহমদ ছফার মতে, শান্তি বাহিনী অনেকটাই তৎকালীন চরমপন্থী বাহিনী, ‘সর্বহারা পার্টি’ প্রভাবিত। তখন চীনাপন্থি বিভিন্ন চরমপন্থী দলের নেতা-কর্মীরা সেখানে আত্নগোপনে থাকতেন। পার্বত্য জনগোষ্ঠির নেতারা তাঁদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। অনেক বিদ্রোহী ভারতের ত্রিপুরায় গিয়ে প্রশিক্ষন, আশ্রয় নিতে থাকে।
এই সময়টাতে সরকারের, পাহাড়ে বাঙ্গালী অভিবাসনের সিদ্ধান্তকে এই সংগঠনটি চরম ভাবে আপত্তি এবং প্রতিরোধ করা শুরু করে। এবং একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের অন্যান্য পরিকল্পনাকেও প্রতিহত করা শুরু করে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করা হলে দলটি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। ১৯৭৬ সালে জে এস এস আবারো আত্ম প্রকাশ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের একটা সমান্তরাল প্রশাসন চালু করে। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে পাহাড় জুড়ে গড়ে উঠলো গ্রাম পঞ্চায়েত, মহিলা সমিতি, যুব সমিতি ও মিলিশিয়া বাহিনী। ১৯৭৫ এর ডিসেম্বর ও ১৯৭৬-এর জানুয়ারীতে একাধিক বড় ধরণের ঘটনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি তথা এম এন লারমা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, যাকে ইংরেজীতে বলা হয় ইনসার্জেন্সীর। ইনসার্জেন্সী তথা এই বিদ্রোহ চলেছিল প্রায় দুই দশক। এই ইনসার্জেন্সীর বিপরীতে বাংলাদেশ সরকার কাউন্টার ইনসার্জেন্সী নামক এক অভিজান চালায়। এই কাউন্টার ইনসার্জেন্সির সময় বিদ্রোহ দমনের নামে বাংলাদেশের সেনাবহিনী এবং সেটেলাররা মিলে বেশ কিছু ম্যাসাকার চালায়। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সেটেলাররা মিলে কাউকজালি নামক একটা গ্রাম আক্রমন করে এবং ৩০০ মানুষ সেই আক্রমনে নিহত হন। একই বছর ৩ মার্চে আরেকটি ম্যাসাকারে সেনাবাহিনী প্রায় ৩০০০ থেকে ৪০০০ আদীবাসী মানুষকে হত্যা করে। ২৫ মার্চ ১৯৮১ সালে সেটেলার এবং সেনাবাহিনী মিলে মাটিরাঙ্গা নামক স্থানে ৫০০ আদীবাসীকে হত্যা করে। ১৯৮৯ সালে লংগদুতে ৪০ জন আদীবাসীকে হত্যা করা হয় এবং প্রায় ১৩০০০ এর মত মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ১৯৮৯ সালে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী ছাত্রদের একটা দলে আক্রমন করে প্রায় ১০০ জনকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৫০০ জুমিয়া নারী ধর্ষিত হন। শান্তি বাহিনীও যে ধোয়া তুলসীপাতা ছিল বিষয়টা তেমন নয়। শান্তি বাহিনী প্রথম বড় ধরনের আলোচনায় আসে, ১৯৭৬ সালে বিভিন্ন ক্যাম্পে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের খুন করে। রাস্তা মেরামতের কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যদের রাতের অন্ধকারে হত্যা করে, নির্মাণ সামগ্রী ধ্বংস এবং অস্ত্র, গোলা-বারুদ লুট করে নিয়ে যায় তাঁরা কালের পরিক্রমায় এই সশস্ত্র বিদ্রোহ মারাত্নক আকার ধারন করে। তাঁদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয় সরকারী স্থাপনা, সামরিক বাহিনী ও বাঙালি গ্রামগুলো। বিশেষ করে গভীর জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রান হারায় অনেক বিত্তহীন বাঙালি। হাজার-হাজার বাঙালি,সেনাবাহিনী,বিডিআর, আনসার,ভিডিপি,বনরক্ষী সহ বহু সরকারি ও বেসরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী খুন ও অপহৃত হয় এই ‘শান্তি বাহিনী’র হাতে। পার্বত্যঞ্চলকে ‘বিদ্রোহ উপদ্রুত অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষনা দেয় সরকার। এমন অবস্থায়, বিদ্রোহ দমনকল্পে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন জিয়াউর রহমান। এ সময়ে সবচেয়ে বড় গনহত্যার ঘটনা ঘটে রাঙ্গামাটির কালামপালিতে। ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ এক নৃশংস হামলায় কমপক্ষে ১০০ জন নীরিহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। ১৯৭৬ সালের কোন একসময় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন শন্তু লারমা ও চবরি মারমা, নেতৃত্বে আসেন প্রীতিকুমার চাকমা। ১৯৮১ সালে শান্তি বাহিনীর সাথে আলোচনার শর্ত হিসেবে মুক্তি পান শন্তু ও চবরি। এদিকে সে সময় খুন হন জিয়া, তাই আলোচনা আর আগায়নি। মুক্ত শন্তু পুনরায় শান্তি বাহিনীর নেতৃত্বে ফিরতে চাইলে প্রীতি গ্রুপের বাঁধার সম্মুখীন হন। দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে শান্তি বাহিনী। একটি লাম্বা (লম্বা) আরেকটি বদি (খাটো)। লাম্বা দলটি লারমা ভ্রাতৃত্ব দের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া শুরু হয় যাদের প্রধান লক্ষ ছিল দীর্ঘ একটা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের জুম্ম জাতীয়তাবাদের অধিকার আদায় করা। অন্যদিকে বদি নামক দলটি প্রীতি কুমার চাকমা এবং ভবতোষ দেওয়ানের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া শুরু করে যাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারত সরকারের সহায়তায় পার্বত্য অঞ্চলকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নতুন একটা রাষ্ট্র গঠনের। দুই ধরনের ভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী এই দুটি দলের বিবাদ রক্তক্ষয়ী গৃহ যুদ্ধের জন্ম দেয় যেখানে অনেক জুমিয়া পরিবারের সদস্য প্রান হারান। ১৯৮৩ সালের ১৪ জুন শন্তু গ্রুপের সদস্যরা প্রীতি গ্রুপের প্রভাবশালী কমান্ডার অমৃত লাল চাকমা ওরফে বলি ওস্তাদ সহ অনেককে খুন করে। প্রতিশোধ হিসেবে ১০ নভেম্বর কয়েকজন সঙ্গী সহ শান্তি বাহিনী তথা জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও শন্তু লারমার বড় ভাই এমএন লারমাকে খুন করে প্রীতি গ্রুপ। এবার শন্তু লারমা শান্তি বাহিনী সহ জনসংহতি সমিতির দায়িত্ব পান। এদিকে এই সুযোগে এরশাদের আত্নসমর্পনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৮৫ সালের ২০ এপ্রিল রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে প্রীতি গ্রুপের ২৩৩ জন আত্নসমর্পণ করে এবং চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল এম. নূররুদ্দীন খানের কাছে অস্ত্র জমা দেয় তাঁরা। তবে দলনেতা প্রীতি কুমার চাকমা আত্নসমর্পণ করেননি। এই অস্ত্র সমর্পনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের গৃহযুদ্ধের অবসান হয় এবং উপদলীয় কোন্দলের অবসান ঘটে। বদি গ্রুপের এই আত্ম সমর্পনে সব থেকে বেশি লাভবান হয় লাম্বা গ্রুপ। তারা পুরো পার্বত্য অঞ্চলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার কারী গেরিলা গ্রুপ হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে। ক্ষমতা সুসংহত করার পর সমগ্র ‘৮০ দশক ব্যাপীই শন্তু লারমার শান্তি বাহিনীর বিদ্রোহী কার্যকলাপের মাত্রা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়। সেনাবাহিনী, সরকারী ও বাঙালি বেসরকারী লোকজন তাঁদের হামলার শিকারে পরিনত হয়। শান্তি বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীও তাঁদের শক্তি বাড়াতে থাকে। গৃহযুদ্ধ পরবর্তি সময়ে একটি দল হিসেবে জে এস এস অনেক বেশি দূর্বল হয়ে পড়ে এবং কোন ধরনের দৃশ্যমান সাফল্য দলটি নিয়ে আসতে পারে না। জে এস এসের আরেকটা ব্যার্থতা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের উপরের স্তরের রাজনীতির গুরুত্ব বুঝে উঠতে না পারা। যার ফলাফল হিসেবে তাদের যে ছাত্র সংগঠনটি ছিল তথা ‘পাহাড়ি ছাত্র সমিতি’র সকল ধরনের কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলতে হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির সকলে তাদের সসস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনীতে যোগ দেয়। প্রতি তিন বছর পর পর পি সি জে এস এস এর জাতীয় কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনটির সুপ্রীম বোডি একটি কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করেন। শান্তি বাহিনীর অর্থের যোগানের বিরাট একটা উৎস হল চাঁদা সংগ্রহ। শুরুর দিকে পাহাড়ীরা শান্তি বাহিনীকে স্বেচ্ছায় চাঁদা প্রদান করত কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের সেই প্রবনতাও কমে আসে। এবার চাঁদা সংগ্রহে নামে তারা। সেই সময় বছরে প্রায় ২০-৩০ কোটি টাকা তাঁরা চাঁদা তুলত। আর শান্তি বাহিনীর সাথে তাঁদের অঙ্গ-সংগঠন, যেমন 'পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ', 'পাহাড়ি নারী পরিষদ'ও চাঁদা আদায় করতো। ১৯৯২ সালে নিজেদের ঘোষিত 'যুদ্ধবিরতি'র পর চাঁদা তোলাই হয়ে দাঁড়ায় এই তিনটি পরিষদের কাজ। তাঁরা এমন নিপুনভাবে চাঁদা তোলা শুরু করেছিল যে, শধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি অধিবাসীরাই চাঁদা দিত তা নয়, চাঁদা দিচ্ছিল (এখনও দিচ্ছে) গোটা দেশবাসী। যে চন্দ্রঘোনার মিলে উৎপাদিত কাগজ কিংবা পাহাড়ের বাঁশ, মূল্যবান ও জনপ্রিয় কাঠ কিনছে, সে-ই চাঁদা দিচ্ছে শান্তি বাহিনীকে। তাঁরা চাঁদা তোলার যে পদ্ধতি প্রয়োগ করতো, তা কর আদায়ের মত এত সুনিপুন ছিল যে, কারো রেহাই ছিল না, এখনও সেখানকার চাষী, ব্যাবসায়ী, সরকারী কর্মচারী এবং সবাই এখনও নিয়মিতভাবে চিঠি পাচ্ছে, আঁকাবাঁকা বর্ণমালায় লেখা সেই চিঠিতে অত্যন্ত উচ্চ হারে চাঁদার পরিমানও নির্ধারণ করা হচ্ছে এবং নিরবে সেই চাঁদা তুলে দিতে হচ্ছে তাঁদের প্রতিনিধিদের হাতে। চাঁদার হারও মাত্রাতিরিক্ত। গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মত শান্তিবাহিনীর নামে দেখা দিয়েছে নানা বাহিনী। তাঁরাও চাঁদা তুলছে, না দিয়ে নিস্তার নেই। না দেওয়ার শাস্তি মৃত্যু।
বাংলাদেশে গনতন্ত্র ফিরে আসলে অর্থ্যাত ১৯৯১ সালের দিকে শান্তি চুক্তির জন্য প্রথম পদক্ষেপ তৎকালীন সরকার কিন্তু তখন সেটা আর খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের দিকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তারা পূনরায় পদক্ষেপ গ্রহন করেন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে ভূমি অধিকার সহ মোট ৭২ টি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৮ হতে সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন পর্যায়ে অস্ত্র সমর্পন করা শুরু করে। এই শান্তিচুক্তির বিরোধীতার মধ্যে দিয়ে মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় আরেকটি সংগঠনের ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমেক্রেটিক ফ্রণ্ট’ — ইউপিডিএফ। তারা একই বছর সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির গেরিলা দল শান্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে চুক্তি বিরোধী ব্যানার ও কালো পতাকা দেখিয়ে প্রথম প্রকাশ্য কর্মসূচি পালন করে যখন তাদের সাংগঠনিক কোন রূপ ছিল না, এটি পরিচিত ছিল প্রসিত-সঞ্চয় গ্রুপ হিসবে। পরবর্তীতে ঢাকায় ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে, এক প্রস্তুতিমূলক কনফারেন্সের মধ্যে দিয়ে সংগঠনটি সুষ্পষ্টভাবে “চুক্তিটি” মৌলিক দাবীগুলো অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে বলে “পার্বত্য চুক্তি”কে আপত্তি জানিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমেক্রেটিক ফ্রণ্ট’ — ইউপিডিএফ। এবং একই সাথে জুম্মমানুষের আত্ম-নিয়ন্ত্রনের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য “পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের” আহ্বান জানায় ।
২০০৬ সালের সময়ে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির ভাঙ্গন শুরু হয় এর প্রেক্ষিতে নতুন অন্যএক সংষ্কারপন্থী আঞ্চলিক রাজনীতিক দল সৃষ্টি হয়, যেটিকে নামকরণ করা হয় জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এম এন লারমা) সংগঠনটির বর্তমান কনভেনিং কমিটি গঠন করে ১০রা এপ্রিল ২০১০ সালে নতুন সংস্কারপন্থী সংগঠনটি অভিযোগ করে যে সন্তু লারমা নেতৃতাধীন ২০-৩১ মার্চের ২০১০ সালে জেএসএস এর ৯ম জাতীয় আলোচনাতে সংবিধান লংঘনের সাথে ৬জন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়, যার মধ্যে ছিলেন মৃত চন্দ্র শেখর চাকমা যিনি দলের ৩য় বারের মতো সাধারণ সম্পাদক পদে দ্বায়িত্ব পালন করেন। সংগঠনটি সন্তু লারমাকে একনায়কসুলভ নেতা বলে অভিহিত করে। বর্তমানে সংগঠনটির উচ্চপদস্থ নেতা-নেত্রীরা হলেনঃ সুধাসিন্দু খীসা (কো-চেয়ারপার্সন), রুপায়ন দেওয়ান (কো-চেয়ারপার্সন), তদিন্দ্রলাল চাকমা (সাধারণ-সম্পাদক), আরো আছেন ইন্জিনিয়ার মৃনালকান্তি ত্রিপুরা, এডভোকেট শক্তিমান এবং নেত্রী কাকলি খীসা।
বাঙালী সেটলারদের সাথে মারমাদের তথা আদিবাসীদের নিত্যদিন সংঘর্ষ ছাড়াও ‘ইউপিডিএফ-জেএসএস’, ‘জেএসএস সংস্কারপন্থী-সন্তু লারমা গ্রুপ’ প্রভৃতির মাঝে পরস্পর বন্দুকযুদ্ধ, বাড়ী বা বাজার থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা, গুম, অপহরণ, চাঁদা আদায় ইত্যাদি এখন স্বাভাবিক ব্যাপার।
পাহাড়ের অন্য সম্প্রদায় গুলোর মত মারমা সম্প্রদায়েরও কেউ কেউ জে এস এস- শন্তু লারমা গ্রুপ, কেউ ইউ পি ডি এফ আবার কেউ জেএসএস-এম এন লারমা গ্রুপ এর সদস্য। জে এস এস- শন্তু লারমা হোক, ইউ পি ডি এফ হোক আর জেএসএস-এম এন লারমা গ্রুপ হোক এই তিন গ্রুপের আসলে কোনটাই মারমা তথা পাহাড়ীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে না। এক একটা গ্রুপকে আড়াল থেকে কল কাঠি নাড়ছে এক এক টা ছায়া। কেউ পাহাড়ীদের নিজেদের মধ্যে শত্রুতা তৈরি করে অখন্ডতা বজায় রাখতে চাইছে আবার কেউ হানাহানির মধ্য দিয়ে খন্ডতা তৈরি করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির ধান্দায় আছে। আসলে এখানে চলছে খন্ডতা আর অখন্ডতার আন্তর্জাতিক রাজনীতি। যেটা থেকে বাঙ্গালী সেটেলাররা তো দূরে থাক পাহাড়ী রাও নিস্তার পায় না। বেশির ভাগ পাহাড়ী জনগনই নিরীহ আম জনতা। তাদের এই রাজনীতির ধারে কাছে ঘেষতেও দেখা যায় না বরং এসব রাজনীতি তে ভীত হয়, তারা আহত হয় আর মারা যায়। তারা ভীত হয় সেনা বাহিনী থেকে, তারা ভীত হয় সেটেলার থেকে, তারা ভীত হয় জে এস এস থেকে আবার তারা ভীত হয় ইউপিডিএফ থেকে। তারা ‘পাহাড়ী’ ‘উপজাতি’ ‘আদিবাসী’ কোনটাই নয়। তারা এদেশের মানুষ, অত্যন্ত দরিদ্র মানুষ।
তথ্য সূত্রঃ
1. Act XXII of 1860 Printed in selections from correspondence on the Revenue Administration of Chittagong Hill Tracts- (1862-1927)
2. মারমা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন, প্রমোশন এন্ড প্রটেকশন অব ইন্ডিজিনাস রাইটস (পিপিআইআর) প্রকল্পের গবেষণাধর্মী গ্রন্থণা কপো সেবা সংঘ, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ঢাকা
3. Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900 (Act I of 1900)
4. Rules for the Administration of the Chittagong Hill Tracts- 1900 (made under section 18 of CHTs Regulation 1900)
5. Rashiduzzaman, M. (July 1998). "Bangladesh's Chittagong Hill Tracts Peace Accord: Institutional Features and Strategic Concerns". Asian Survey (University of California Press)
6. Shelley, Mizanur Rahman (1992). The Chittagong Hill Tracts of Bangladesh: The untold story. Centre for Development Research, Bangladesh.
7. Francis Buchanan in South-Eastern Bengal- 1798. Edited by Williem Ven Schendal.
8. "Parbatya Chattagram Jana-Samhati Samiti". Banglapedia - National Encyclopedia of Bangladesh. Retrieved 2008-06-11.
9. রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯
10. Thum, Gregor (2006–2007). "Ethnic Cleansing in Eastern Europe after 1945". Contemporary European History 19 (1)
11. Rules for Territorial Circles in the Chittagong Hill Tract (Selected Correspondence on the Revenue Administration of Chittagong Hill Tracts).
;
লেখকঃ আসাদ রহমান, গবেষক
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।