বাঙলাদেশে লেখকের স্বাধীনতা
অনন্য আজাদ
প্রিন্টঅঅ-অ+
একজন লেখক স্বাধীনভাবে লিখে যাবে এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হল লেখকের লেখার উপর হস্তক্ষেপ। লেখক তাঁর মত প্রকাশ করবে; সেটা কারো পক্ষে যেতে পারে, কারো বিপক্ষে। আবার কখনো ঘটনার প্রেক্ষিতে দু'পক্ষকেই উড়িয়ে দিতে পারে। একজন লেখক সবকিছু নিয়ে চিন্তা করবে, লিখবে। যার পড়ার সে পড়বে, যার জানার সে জানবে কিন্তু তাই বলে লেখকদের উপর বর্বর হামলা চালানো যায় না। উন্নত দেশগুলিতে লেখকদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে কার্পণ্যবোধ করে না। সেটা পক্ষে যাক আর বিপক্ষে। কিন্তু মুসলিম দেশগুলিতে লেখকদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া তো দূরের কথা-সেখানে লেখকের মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়। মানসিক অশান্তি-নির্যাতন-আক্রমণ-হত্যা করাও জায়েজ ঘোষণা করা হয়। সেই ধর্ম যে কী পরিমাণ হিংস্র-বর্বর সেটা বিশ্ববাসী জানতে পারে। দেশের জন্যও এটি বিরাট লজ্জাজনক। উদ্ভট বিষয় হল, এ বিষয়ে তাদের নুন্যতম লজ্জাবোধ হয় না। পৃথিবীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করা হয়। কার্টুন, বিজ্ঞাপন, সিনেমা নির্মাণ করা হচ্ছে কিন্তু ইসলাম ধর্ম নিয়ে কোন চিত্র তুলে ধরলে তাঁকে কতল করার নির্দেশ উঠে। মুসলমানরা স্বর্গে যাবার আশায় সত্য স্বীকার করতে পারে না। তাই বিশ্ব জেনে গেছে মুসলমানদের সীমাবদ্ধতা। এবং পৃথিবীর অধিকাংশ কুখ্যাত টেরোরিস্ট যেহেতু মুসলমান তাই সহজেই কেউ টেরোরিষ্ট কিংবা মৌলবাদী শুনলেই মুসলমান বলে ভেবে নেয়। এটা যে কী পরিমাণ লজ্জাদায়ক ব্যাপার তা কেনো এতো শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পরও মুসলমানেরা বুঝে না! দুঃখজনক।
জাতিগত ভাবে বাঙালেরা প্রচুর পরিমাণে অসভ্য, এই সহজ সত্যটা স্বীকার করার মতো বাঙালের সংখ্যাও নগণ্য। পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙলাদেশ ক্ষুদ্র একটি বিন্দু হলেও বাঙালের দাম্ভিকতা বিশ্বের এক নাম্বার দেশের মানুষদের থেকে কম নয়। এখানে অধিকাংশ মানুষেরা মূর্খ এবং নিজের মূর্খতা লুকোনোর জন্য দাম্ভিকতা দেখিয়ে থাকে কিন্তু স্বীকার করতে কেউ’ই রাজি নয়। এই দেশে কোন এক উদ্ভট কারণবশত একটি নিয়ম চালু আছে। সেটা হল লেখককে কোন পক্ষের হয়ে লিখতেই হবে। এই পন্থাটি কবে থেকে এবং কারা চালু করেছিল সে বিষয়ে জানা নেই। তবে ঘটনাটি যে খুব’ই হাস্যকর ও মেধাহীনদের কাজ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখানে মানুষরূপী প্রভুদের প্রণাম করে লিখতে হয় নয়তো দেশদ্রোহী আখ্যা পেতেও সময় লাগে না। বাঙালদের মধ্যে চিন্তার সীমাবদ্ধতা ব্যাপকরূপে প্রকাশ পায়। তারা প্রচলিত কিছু ধ্যানধারণা-কর্মপন্থা নিয়ে গর্ববোধ করে। এর বাইরেও যে একটি বিশাল আকৃতির জগত থাকতে পারে সে বিষয়ে তারা উদাসীন। এ ব্যাপারেও বাঙালের লজ্জা হওয়ার পরিবর্তে তারা নিজেদের সর্বোত্তম ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। লেখনীর ক্ষেত্রে বাঙালেরা সব লেখককে ধারণ করতে পারে না। যে লেখক এককেন্দ্রিকভাবে লিখে গেছেন তাঁকেই অন্ধের মতো সম্মান প্রদর্শন করে যাবে।
লেখককে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাঙাল হোক আর মুসলমান হোক- কেউ’ই সব ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দিতে পারে না। লেখককে ধারণ করার ক্ষেত্রে এটাই বাঙাল মুসলমান কিংবা মুসলমান বাঙালের ভয়াবহ রকমের সীমাবদ্ধতা। এবং এটাই বাস্তব সত্য।
আইন করে কখনো একজন লেখকের চিন্তাশক্তি স্থির করা যায় না। আর যদি লেখনীশক্তি এককেন্দ্রিক কলমে বদ্ধ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে তিনি ভাঁড়গোত্রীয় লেখকদের কাতারে পড়ে। লেখক হিশেবে তিনি গুরুত্বহীন। তবে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই সব দলকেন্দ্রিক লেখকেরা জনপ্রিয়। লেখার মাধ্যমে লেখক নিজের চিন্তা প্রকাশ করবে। যে চিন্তা হবে সর্বোচ্চ স্বাধীন। সেটা কারো পছন্দের কারণ হতে পারে, আবার কারো অপছন্দও হতে পারে। একজন লেখক কখনই মহাজগতের সবার মন জুগিয়ে চলতে পারবে না। কিন্তু এই অতি স্বাভাবিক ও সাধারন ব্যাপারটি বাঙাল মুসলমানরা মেনে নিতে অপারগ।
বিচিত্র এ দেশের মানুষের অনুভূতি। বিচিত্র তাদের অনুভূতির সহনশীলতা। এই বিচিত্র অনুভূতির জন্য তসলিমা নাসরিনকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা হয়েছে। শামসুর রাহমানের বাসায় আক্রমণ করা হয়েছে। বাঙলাদেশের সবচে’ শিক্ষিত জ্ঞানী আহমদ শরীফকে বাঙলার রুশদী খেতাবে ফাঁসি চেয়েছিল। আরজ আলী মাতব্বরকে সহ্য করতে হয়েছিলো অসহ্য যন্ত্রণা। আসিফ মহিউদ্দীনকে মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিলো এবং পরবর্তীতে হয়তো তসলিমা নাসরিনের মতই পরিণাম হবে।
এই দেশে মৌলবাদীরা নির্বিঘ্নে চলতে পারে, কিন্ত একজন লেখককে চলতে হয় উদ্বিগ্ন চিত্তে। এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের দেশে রেখে দেশের খরচে প্রতিপালন করা হয়, আর লেখককে দেশ ছাড়তে হয় জীবন বাঁচাতে। এই দেশে দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর আমলা রাজনীতিবিদরা তাদের অন্যায়ের জন্য কোনো শাস্তি পায় না, কিন্তু লেখককে শারীরিক মানসিক শত শাস্তি ভোগ করতে হয়। এই দেশে সবচেয়ে বড় অপরাধ সত্যের পক্ষে থাকা, মুখোশ উন্মোচন করা, ভন্ডামি, অন্যায়, শোষনের বিরুদ্ধে বলা, যুক্তিবাদী লেখা উপস্থাপন করা। এই দেশে সুখে থাকার একটাই কৌশল হল অসৎ পথে চলা। সৎ ব্যক্তির অবস্থান এখানে নর্দামার চেয়েও নিকৃষ্ট জায়গায়।
লেখক: কলামিস্ট
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্য
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।