- হোম
- >
- ইতিহাস-ঐতিহ্য
- >
- স্লিপ অব টাং ?? (হিন্দু-মুসলিমের অখণ্ড বাংলা - ২)
স্লিপ অব টাং ?? (হিন্দু-মুসলিমের অখণ্ড বাংলা - ২)
১৯৪৬ সাল। অস্থির, চঞ্চল অখণ্ড পরাধীন ভারতবর্ষ।
পরাধীনতার অন্ধকারে কেটে গেছে প্রায় একশ নব্বই বছর। যেন আলো বলে কোনকিছু ছিল না কোনদিন। যেন স্বাধীনতার সূর্য ঝলমলে আকাশে দীপ্তমান ছিল না কখনো। শতাব্দীর সেই অভিশপ্ত অচলায়তন ভেঙে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেস, মুসলিম লীগের পক্ষে চল্লিশ কোটি ভারতবাসী চাপের পর চাপ দিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক চাপ শুরু হয়েছে বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই। সেই সাথে যোগ হয়েছে বাংলার ক্ষত্রিয় নেতাজী সুভাষ বোসের মরণ আঘাত।
আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের বন্দি রেখেও ‘বিচার’ করবার সাহস হচ্ছে না ক্ষুদিরাম, সূর্য সেনের বিচারকদের। হঠাৎ বাতাসে হাত থেকে খৈ উড়ে গেলে যেমন ‘উড়ো খৈ গোবিন্দায় নমঃ’মন্ত্র পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ, ঠিক তেমনি হাত থেকে প্রায় ফসকে যাওয়া ভারতবর্ষকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীন করে দেবার ইচ্ছেটা উদারতার সাথে প্রকাশ করেছেন ইংল্যাণ্ডের অ্যাটলি-মন্ত্রীসভা।
কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর হলো না ! জিন্না সবুজ স্বাধীনতা চান তো কংগ্রেস চায় হলুদ। কংগ্রেস চারকোণা স্বাধীনতা চায় তো জিন্না চান গোলাকার। জিন্না পাকিস্তান চান তো কংগ্রেস চায় অখণ্ড ভারত। এইসব গোলক ধাঁধায় ল্যাজে-গোবরে হয়ে কিছুদিন আগেই ব্যর্থ মিশন নিয়ে ফিরে গেছেন ক্রিপ্স্ সাহেব। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স্, ইউরোপের চাণক্য। যুদ্ধের সময় সমস্ত ইউরোপ যখন হিটলারের জেনারেল রোমেল, গুটেনবার্গ আর গুডেরিয়ানের ব্লিৎসক্রিগ আর প্যান্থারের আঘাতে ভেসে যাচ্ছে খড়কুটোর মতো, প্রতিদিন নুয়ে আসছে চার্চিলের মেরুদণ্ড, ঠিক তখনই ক্রিপ্স্-কে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়েছিল মস্কোতে।
সমস্ত অসম্ভবের মধ্যে এই এতটুকু আশা, যদি কোনরকমে রাশিয়া আর জার্মানির মধ্যে যুদ্ধটা বাধানো যায় ! পারলে ঐ লোকটাই পারবে, নাহলে আর কোনো উপায় নেই হিটলারকে ঠেকানোর। পর্দার আড়ালে কি ঘটে গেল, জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করল, মোড় ঘুরে গেল বিশ্বযুদ্ধের। খুশিতে ফেটে পড়ল মিত্রশক্তি। ক্রিপ্স্ পেয়ে গেলেন ইংল্যাণ্ডের সর্বোচ্চ খেতাব ‘নাইটস্, হয়ে গেলেন স্যার ক্রিপ্স্। গতবারের ব্যর্থতায় অভিজ্ঞ স্যার ক্রীপ্স্ এবার এসেছেন স্যার প্যাথিক লরেন্স-এর কেবিনেট মিশনের সদস্য হয়ে।
কিন্তু এমন কত মিশন তো এল আর গেল। কাজের কাজ কিছুই হয় না। মিটিং, প্রস্তাব, মিশন চলছেই চলছে কিন্তু স্বাধীনতাটা কবে আসবে বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এই এল ব’লে। আশায় বুক বাঁধে চল্লিশ কোটি লোক। আবার নিরাশায় আঁধার ছেয়ে আসে। অবশ্য, কাজটা অসম্ভব জটিলও বটে। গত ক’বছরে লীগ কংগ্রেস আর বৃটিশ মিলে স্বাধীনতার পথটাকে সমস্যায় সমস্যায় এতই পিছলে করে দিয়েছে যে বেচারা স্বাধীনতা দু’পা এগিয়েই হয় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে অথবা তিন-পা পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে, সে যে একদিন আসবেই - আর সেদিন খুব দূরেও নয় - তা স্পষ্ট। এছাড়া আছেন উপনেতা, পাতিনেতার দল। “তাঁরা নিশ্চয়ই চান দেশ স্বাধীন হোক, কিন্তু তাতে যদি তাঁদের মাতব্বরি না থাকে সে স্বাধীনতার কোনো দরকার নেই”- মাওলানা আবুল কালাম আজাদ – “INDIA WINS FREEDOM”।
এরপর এল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি। প্রথমে বিশ্বাস হতে চায় না। বারবার চোখ রগড়ে খবরের কাগজ দেখছে সবাই, বারবার ষ্টেশন বদল করে রেড়িও শুনছে। না, কোনো ভুল নেই। কেবিনেট মিশন সফল হয়েছে। স্বাধীন অখণ্ড ভারত মেনে নিয়েছে কংগ্রেস মুসলিম লীগ দু’দলই। অভূতপূর্ব খেলা দেখিয়েছেন রাজনীতির যাদুকর স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স্। কংগ্রেসকে বলেছেন -“অখণ্ড ভারত চাও ? এই রইল তোমার অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা।” জিন্নাকে বলেছেন -“পাকিস্তান চাও তো ? এই রইল তোমার স্বাধীন পাকিস্তানের রূপরেখা।” এ কি হল, কেমন করে হল ? স্বাধীন অখণ্ড ভারত আর স্বাধীন পাকিস্তান একই সাথে হয় কি করে ? নিশ্চয়ই হয়, নইলে কংগ্রেস মুসলিম লীগের বাঘা বাঘা নেতারা এটা মেনে নিল কি করে ?
এই হলেন স্যার ক্রিপ্স্। গতবার জটিল সমস্যার জটিল সমাধানের চেষ্টা করে পারেননি। এবার একটা সহজ সরল সমাধান করে দিলেন। তিনটে অঞ্চলে ভাগ হয়ে স্বাধীন হবে ভারতবর্ষ, মোটামুটি (ক) আজকের পাকিস্তান,(খ) আজকের ভারত, ও গ) বাংলা ও আসাম। স্বভাবতঃই ক ও খ অঞ্চলে মুসলমান হবে মেজরিটি। নিজেদের সম্পদের ওপর এ অঞ্চলগুলোর থাকবে অখণ্ড অধিকার, কেন্দ্র শুধু সামরিক, যোগাযোগ এবং পররাষ্ট্র নীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। দশ বছর এভাবে চলার পর যদি মুসলমানরা নিজেদের রাষ্ট্র চায়, তা তারা করতে পারবে। তবে তাতে তাদের বিশেষ কিছু লাভ হবে না কারণ অখণ্ড ভারতের ফেডারেল রূপরেখায় মুসলমানরা আর্থিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে তাদের অঞ্চলে স্বাধীনতাই পাচ্ছে। ব্যাপারটা পাকিস্তান আমলে আমাদের ছয়দফার কাছাকাছি।
আনন্দে ফেটে পড়ল ভারতবর্ষ। স্বাধীনতা ! শত বছরের সহস্র শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা সেই পরম, সেই চরম, সেই মোক্ষ ! সহস্র লেখক, কবি দার্শনিকের স্বপ্ন, কত সন্তানহারা পিতামাতার, পিতৃমাতৃহীন এতিমের অশ্রু ! কত রশীদ আলী, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, শাহনেওয়াজ, ভগৎ সিং, কত তিতুমীর, সুভাষ বোস, মঙ্গল পাণ্ডে, ডান্ডি খান, ঝাঁসীর রাণী, তাঁতিয়া টোপি, টিপু সুলতানের আত্মদানে গড়া সেই উজ্জ্বল সূর্য। কত প্রীতিলতা, বীনা দাস, ইলা মিত্র, মাতঙ্গিনী হাজরার রক্তস্রোত। কত ফাঁসি, কত আন্দামান, অন্ধকার টর্চার চেম্বারের কত মর্মভেদী আর্তনাদ। তার ফসল এবার উঠবে ঘরে ! অর্ধেক গোলার্ধ ওপার হতে শেয়াল শকুনরা এসে দেশটাকে ছিঁড়ে খাবে না আর। ডিভাইড রুল-এর খেলা হবে বন্ধ, সাদাদের ক্লাবের দরজায় ঝোলানো থাকবে না - ‘ভারতীয় এবং কুকুরের প্রবেশ নিষেধ’।
অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসছে নিয়তি
কেউ জানে না, ক’দিন পরই হিসাবের কড়ি বাঘে খেয়ে যাবে। মাত্র দু’তিনটে কথার আঘাতে চিরদিনের জন্য বদলে যাবে আমাদের সমস্ত উত্তরপুরুষদের ভাগ্য। অবধারিতভাবে ঘটে গেল ঘটনাটা। কেবিনেট মিশন গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ২৪শে মে কংগ্রেস দ্বারা, এবং ২৫শে জুন মুসলিম লীগ দ্বারা। ১০ই জুলাই বোম্বে রেলওয়ে ষ্টেশনে সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস প্রেসিডেণ্ট নেহেরু বলে ফেললেন, কেবিনেট মিশন গৃহীত হয়েছে রাজনৈতিক দল দ্বারা কিন্তু আমরা বসবো সার্বভৌম পার্লামেন্ট - সেখানে যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আমাদের আছে।
বলে কি ! থ’হয়ে গেল ভারতবর্ষের মুসলমান। পার্লামেণ্টে ওরাই যে মেজরিটি ! তবে ? তবে কি হিন্দুরা মেজরিটির জোরে সংসদে ইচ্ছেমত প্রস্তাব আর আইন পাশ করবে ? ব্যাকুল উম্মুখ হয়ে তাকাল সবাই জিন্নার দিকে। সাথে সাথে হৈ হৈ করে উঠলেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মওলানা আবুল কালাম আজাদ সহ অন্যান্য নেতারা – “ওটা নেহেরু'র ব্যক্তিগত মত মাত্র - ওটা কংগ্রেসের সিদ্ধান্তও নয় নীতিও নয়. ওটা স্লিপ অফ টাং - "মুখ ফস্কে" বেরিয়ে গেছে”!! কিন্তু পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিলেন চতুর জিন্নাহ। তিনি লীগের বিশেষ অধিবেশন শেষে ঘোষণা করলেন “পাকিস্তান অর্জনের জন্য মুসলিম জাতির প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সময় এসেছে এবং সরকার প্রদত্ত সর্বপ্রকার খেতাব বর্জনের জন্য মুসলমানদের প্রতি এই কাউন্সিল আহ্বান জানাচ্ছে।”
১৬ই আগষ্ট ঘোষণা করা হল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস। এবার এল খাঁড়ার ঘা। কোটি কোটি ক্ষুব্ধ মুসলমানের প্রচণ্ড আবেগ প্রকাশের পথ খুঁজছে অথচ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আসলে কি, কিভাবে সেটা করা হবে তা কিছুই বলা হল না। এদিকে বাংলার মুসলিম লীগ নেতা খেতাবধারী খাজা নাজিমুদ্দীন বিচলিত হয়ে ঘোষণা করলেন - “আমাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আসলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে।” নিজের দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতার মুখে এহেন উস্কানীমূলক সাম্প্রদায়িক ঘোষণা শুনে বাংলার হিন্দুরা স্বভাবতঃই প্রথমে শঙ্কিত এবং পরে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলকাতায় এবং পরে বাংলা বিহারে সর্বনাশা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেমে এল কেয়ামতের মতো। বহু হাজার নিরপরাধ হিন্দু-মুসলিমের রক্তে ভেসে গেল কেবিনেট মিশন।
স্বাধীনতা দেবার কথা ছিল ১৯৪৮ সালে, ভয়াবহ দাঙ্গার হিংস্রতায় ত্রস্ত ব্রিটিশ সরকার বলে দিল – “নারে বাবা - তোমাদের হ্যাপা তোমরা সামলাও, আমরা এক বছর আগে ১৯৪৭ সালেই যাচ্ছি”। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তান ও ১৫ই আগষ্ট ভারত স্বাধীন হল।
শূন্যে মিলিয়ে গেল হিন্দু-মুসলিমের অখণ্ড বাংলা। নিজেদের সম্পদে সমস্ত অধিকার নিয়ে বৃহত্তর বাংলার স্বায়ত্বশাসনের সম্ভাবনা এভাবেই আমাদের হাতের কাছে এসেও চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল, শুধু একটা মানুষের "মুখ ফস্কে" কয়েকটা কথার জন্য ॥
লেখক: ডিরেক্টর, শারিয়া আইন ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেস
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।