কমলগঞ্জের ভয়াবহ স্মৃতির দিন
আবার ফিরে এসেছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জবাসীর ভয়াল স্মৃতির দিন মাগুরছড়া ট্রাজেডির ১৬তম বার্ষিকী। ১৪ জুন আসলেই মৌলভীবাজার জেলাবাসীকে মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়াল স্মৃতির কথা। সেদিন মানুষের মন কত ভীত ছিল। কখন এসে আগুনের লেলিহান শিখায় গ্রাস করে ফেলবে।
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে ১টা ৪৫ মিনিটে মাগুরছড়া গ্যাসকূপে বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে ছিল গোটা কমলগঞ্জ। আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠেছিল মৌলভীবাজার জেলার সুনীল আকাশ। ভীত-সন্ত্রস্থ লোকজন ঘরের মালামাল রেখে প্রাণভয়ে ছুটে ছিল দিগিবিদিক। প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে উঠা আগুনের লেলিহান শিখায় লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। আগুনের শিখায় গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেষ্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট- চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
পরিবেশ সংরক্ষণবাদীদের তথ্য মতে, ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির বিনাশ সাধন হয়। সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ থাকে। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা।
বিভিন্ন সংগঠন মাগুরছড়া দুর্ঘটনার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করে এলেও দীর্ঘ ১৬ বছরেও ক্ষতিগ্রস্থদের দাবিকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে ১৬ বছর ধরে কমলগঞ্জ তথা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষের মনে মাগুরছড়া বিস্ফোরণের আগুন সন্দেহের দাবানল হয়ে জ্বলছে। তৎকালীন সরকার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জোরালো ভূমিকা পালন করেনি। ফলে মাগুরছড়া দুর্ঘটনার ১৬তম বার্ষিকী পূর্ণ হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে আজো ক্ষতিপূরণ না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্থরা নীরবে চোখের জল ফেলছে।
এ নিয়ে মৌলভীবাজার তথা সিলেটের জনমনে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরিত্যক্ত এলাকার উত্তর টিলায় সবুজায়ন করা হয়েছে। মূল কূপটি এখনো পুকুরের মতো ধারণ করে টিকে আছে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করা হয়েছে। টিলার ওপর সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিলেও মাঝে মধ্যে আগুনের পোড়া ডালপালা বিহীন কালো রঙের গাছগুলো অগ্নিকান্ড দুর্ঘটনায় সাক্ষী এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
মার্কিন অক্সিডেন্টাল কোম্পানী ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও পরিপূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ তাদের অনুসারী কোম্পানী শেভরনের কাছে বিক্রি করেছে। বিগত ২০০৮ সালে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাগুরছড়া ও লাউয়াছড়ার বুক চিরে শেভরনের ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করেছে। এতে একাধিক বাড়ির দেয়াল ও মসজিদে ফাটল দেখা দেয়ায় স্থানীয়ভাবে অনেক ব্যক্তিবর্গ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।
জানা যায়, কমলগঞ্জ উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতরে লাউয়াছড়া ফরেষ্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালে সাইসলিক সার্ভেতে গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে উৎপাদন ভাগাভাগির চুক্তিতে ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারী মার্কিন বহুজাতিক তেল ও গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানী অক্সিডেন্টালের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমতি প্রদান করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল কোম্পানী মাগুরছড়ায় গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করেছিল ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানীর কাছে। গ্যাস উত্তোলনে ১৪ নং ব্লকের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপের খননকালে ৮৫০ মিটার গভীরে যেতেই ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্য রাতে ঘটে ভয়াবহ বিষ্ফোরণ।
এ সময় শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কিঃমিঃ (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতাপ বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয়। কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০ টি চাবাগানে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের বৃক্ষ সম্পদ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ছাড়া ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। গ্যাস বিস্ফোরনের পর অক্সিডেন্টাল তাদের সহোদর ইউনোকলের কাছে দায়িত্ব দিয়ে এ দেশ ত্যাগ করলে দুই বছর পর ফুলবাড়ি চা বাগান, পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাড়ি-ঘর, পান জুম এলাকার ক্ষয়ক্ষতি বাবদ আংশিক টাকা প্রদান করে ইউনোকল।
অন্যদিকে দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কমলগঞ্জ শ্রীমঙ্গল সড়ক ধারে সামাজিক বনায়নের রোপিত গাছের জন্য ৩ ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ প্রদান করা হয়। দীর্ঘ ৬ মাস কমলগঞ্জ শ্রীমঙ্গল সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে ক্ষতি পূরণ বাবত বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু ক্ষতিপুরন দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ও গ্যাস বাবত কোন ক্ষতিপূরণ করা হয়নি এবং কোন সরকারই ক্ষতিপূরণ আদায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় জনমনে সন্দেহ বিরাজ করছে। দুর্ঘটনার পর তৎকালীন সরকারের খনিজ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিডেন্টালের দায়ীত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়।
দূর্ঘটনার ১৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও গ্যাস ক্ষেত্রের মালিকানা অক্সিডেন্টাল থেকে ইউনোকল তারপর দায়িত্ব পেয়েছে তাদেরই স্বদেশী কোম্পানী শেভরন। এই দীর্ঘ ১৫ বছরে এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ ক্ষতি পূরণ পায়নি সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশন, ক্ষতিগ্রস্ত বন , পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য। বন বিভাগের হিসাবমতে প্রত্যক্ষ ক্ষতি ৩২ দশমিক ৫৩ কোটি এবং অন্যান্য ক্ষতি মিলিয়ে মোট ১৭৬ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা। এই সময়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় পুরো হিসাব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০৯ কোটি টাকা নিরূপন করে মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টালের কাছে দাবি জানায়।
১৯৯৯ সালের আগষ্ট মাসে অক্সিডেন্টাল কোম্পানী মাগুরছড়া গ্যাসকূপসহ তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় মার্কিনের অন্য কোম্পানী ইউনিকলের কাছে হস্তান্তর করে। ইউনিকল দায়িত্ব নেয়ার পর ক্ষতিপূরন বিষয়ে টালবাহানা শুরু করে। কিন্তু গ্যাস উত্তোলনে ইউনিকল মাগুরছড়া পরিত্যক্ত কূপ এলাকার প্রায় ৩’শ গজ পশ্চিমে নতুন করে একটি ও জেরিন চাবাগানের অভ্যন্তরে একটি কূপ খনন শেষে গ্যাস উত্তোলন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে কালাছড়া গ্যাস কূপের সঙ্গে সংযুক্ত করে জাতীয় গ্যাস গ্রীড লাইনে অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ করছে। বর্তমানে শেভরন এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
শেভরন সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সনের ত্রি-মাত্রিক ভূ-ত্বাত্তিক জরিপ অনুয়ায়ী কমলগঞ্জের পাত্রখোলা চা বাগান থেকে দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকা পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায় ৫ শতাংশ এলাকায় গ্যাস রয়েছে। জাতীয় উদ্যানের পরিবেশ রক্ষায় শেভরন অঙ্গীকারবদ্ধ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির দেয়া এক রিপোর্টে জানা যায়, লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা গ্যাসের আগুনে ক্ষতি হয়। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২০ দশমিক ৫০ একর এলাকা। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ২০ একরে ৪.৭৫ ঘনফুট গাছ-গাছালির, ৫৫ হাজার ২’শ টি পূর্ণ বয়স্ক বাঁশ এবং ১ লাখ ১৫ হাজার অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুড়ে গেছে। ক্ষতির পরিমান ৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২৬ একরের বড় আকৃতির বহু সংখ্যক দামী বৃক্ষ সম্পূর্ণ ও আংশিক পুড়ে যায়। একইভাবে ৪১.৫০ একরের ২২.৮২৫ ঘনফুট গাছ-গাছালিরও আংশিক ক্ষতি ধরা হয়। সব মিলিয়ে পুড়ে যাওয়া গ্যাস, ক্ষতিগ্রস্থ বন ও পরিবেশের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি আদায়ে মার্কিন কোম্পানী সমূহের টালবাহানায় মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরনের ১৪ বছরে ৩ টি কোম্পানীর হাত বদল হয়েছে। কিন্তু পুুরো ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।
সরজমিন কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, গ্যাস কূপ বিস্ফোরণের পরিত্যক্ত মাগুরছড়া এলাকার টিলা কেটে সমতল ও স্থলাকার করা হয়েছে। মূল কূপ স্থলটি এখনও পুকুরের মত ধারণ করে টিকে আছে। চর্তুদিকে কাটা তারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরী করা হয়েছে। টিলার উপর সবুজ বনায়নের উদ্দ্যোগ নিলেও মাঝে মাঝে আগুনের পুড়া মাথা ভাঙ্গা ডাল-পালা বিহীন কালো রঙের গাছ গুলো দুর্ঘটনার নিরব স্বাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরনের ১৬ বছরে ৩টি কোম্পানীর হাত বদল হয়েছে। অথচ আজও মিলেনি সমূহ ক্ষতিপূরণ। মাগুরছড়া ট্রাজিডির ১৬ বছর পার হলেও রহস্যজনক কারণে এ সংক্রান্ত তদন্ত রিপোর্ট আজও জনসম্মুখে প্রকাশ না করায় বৃহত্তর সিলেট তথা কমলগঞ্জ উপজেলাবাসী আজও এ রহস্যের আগুনে পুড়ছে। মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ১৬ তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ ১৪ জুন শনিবার বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে দিবসটি পালন করেব।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।