ঘুরে আসুন বালিয়াটি জমিদার বাড়ি
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে আনুমানিক আট কিলোমিটার পশ্চিমে এবং ঢাকা জেলা সদর থেকে পয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে অবস্থিত। মোট সাতটি স্থাপনা নিয়ে এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত।
মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটী গ্রামে এই জমিদারবাড়ীর অবস্থান। ঐতিহ্য বুকে ধরে এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। একটি নিম্নবিত্ত সাহা পরিবার থেকেই পরবর্তীতে বালিয়াটী জমিদার বংশের উদ্ভব।
মহেশরাম সাহা নামে জনৈক বৈশ্য বারেন্দ্র শ্রেণীর ছোট্ট এক কিশোর ভাগ্য অন্বেষণে বালিয়াটীতে আসে এবং জনৈক পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকরি নেয়। পরে মহেশরামের ছেলে গণেশ রাম লবণের ব্যবসায় উন্নতি করেন। গণেশ রামের চার ছেলের মধ্যে একজন হলো গোবিন্দরাম। তিনি বিয়ে করেন বালিয়াটীতে। তার ঘরে জন্ম নেয় চার ছেলে। যথাক্রমে আনন্দরাম, দধিরাম, পণ্ডিতরাম ও গোপালরাম। এই চার ভাইয়ের পৃথক ব্যবসা ছিল। ওই চার ভাই থেকেই বালিয়াটী গোলাবাড়ী, পূর্ববাড়ী, পশ্চিমবাড়ী, মধ্যবাড়ী ও উত্তরবাড়ী নামে পাঁচটি জমিদার বাড়ির সৃষ্টি হয়। আনুমানিক ১৭৯০ সালে ওই চার ভাইয়ের মাধ্যমেই বালিয়াটী জমিদার বাড়ীর গোড়া পত্তন হয়।
বালিয়াটীর জমিদার বাড়ীতে আছে দৃষ্টিনন্দন ইমারত, নির্মাণ কৌশল আর অলংকরণে অপূর্ব। বিশাল বিশাল ভবন জমিদার আমলে জমিদারদের বিত্ত বৈভবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ঝড়-তুফান, বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে। জমিদারবাড়ীর সিংহ দরজায় প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে প্রশস্ত আঙ্গিনা। একই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে চারটি বহুতল ভবন। এগুলোর পেছনে জমিদার অন্দরমহল এবং রয়েছে কয়েকটি পুকুর। বালিয়াটীর জমিদারবাড়ী।
লবণের একটি বড় গোলা ছিল বলেই এ বাড়ির নাম গোলাবাড়ী। গোলাবাড়ীর চত্বরে দোল পূর্ণিমার ১২ দিন পর বারুণীর মেলা বসত। সেই মেলা এখন বসে বালিয়াটীর পুরনো বাজারে। এ বাড়ীর জমিদাররা ছিলেন ধর্মপ্রাণ। বাড়ীর মন্দিরে বিগ্রহের পূজা হতো। কিন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওই বিগ্রহ এবং গোলাবাড়ী পাকিস্তানী সৈন্য এবং রাজাকাররা লুটপাট করে। জমিদারবাড়ীর পশ্চিম অংশে অবস্থিত বলেই এ বাড়ীর নাম পশ্চিমবাড়ি। দধিরাম পশ্চিমবাড়ীর জমিদারদের পূর্ব-পুরুষ। এই বাড়ীর জমিদাররা বাণিজ্যকেন্দ্র সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঝালকাঠী, নলছিটি প্রভৃতি স্থানে লবণ, সুপারী, চাল ইত্যাদি ব্যবসার মাধ্যমে অনেক অর্থের মালিক হন। এদের ঐশ্বর্য বেড়ে উঠলে তারা জমিদারী ও তালুকাদারী কিনতে শুরু করেন। এই বাড়ীর জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে এটি ছিল স্কুল। বর্তমানে এটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কলেজে উন্নীত হওয়ার সময় স্কুল শাখা আলাদা হয়। সেটি এখন কে এল জুবিলী হাইস্কুল নামে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এছাড়া ওই জমিদাররা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং পাঠাগার নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বালিয়াটীর পূর্ব অংশে এ বাড়ীর অবস্থান বলেই এ বাড়িটির নাম পূর্ববাড়ী। এ বাড়ীর প্রথম জমিদার পুরুষ রায়চাঁন। তিনি দুটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের সম্পত্তির দশ আনা অংশ এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তানদের দান করেন ছয় আনা অংশ। দশ আনির জমিদারবাড়িটিই বর্তমানে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এ বাড়িটি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর অধিগ্রহণ করে এবং এখনো এর সংস্কার কাজ চলছে। এ বাড়িটি বালিয়াটী প্রাসাদ নামে পরিচিত। এখানে পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত চারটি সুবৃহৎ অট্টালিকা বিদ্যমান। এগুলো বড় তরফ, মেজ তরফ, নয়া তরফ এবং ছোট তরফ নামে পরিচিত। ছয় আনি জমিদারবাড়ির অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। ৫.৮৮ একর জমির ওপর বাড়ির মূল সৌধমালা। গোলাপ রাম হলেন এ বাড়ীর প্রাচীন পুরুষ। এ বাড়ীর এক তেজস্বিনী মহিলা জমিদারের নাম উজ্জলা রানী রায় চৌধুরানী। এ বাড়িটি স্থাপত্যকলার দিক দিয়ে বহু প্রাচীন। এই বাড়ীর অনেক স্থাপনাই এখন আর বর্তমান নেই। বালিয়াটীর জমিদারবাড়ী
পণ্ডিত রাম হচ্ছেন এ বাড়ীর আদিপুরুষ। এ জমিদারের এক প্রাণপুরুষ শাম্বিকা চয়নের মেয়ে কিরণ বালাকে বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের দানবীর শহীদ রনদাপ্রসাদ সাহা (আর পি সাহা)।তিনি বালিয়াটীতে হাসপাতাল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জমিদার অনুমতি দেননি বলে তিনি নিজের গ্রাম মির্জাপুরে তার মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানীরা আর পি সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আজও ফিরে আসেননি। জমিদারদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য কীর্তির মধ্যে রয়েছে ধামরাইয়ের রথ, ঢাকাস্থ কে এল জুবিলী হাইস্কুল, ঢাকাস্থ জনগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বালিয়াটী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যালয়, বালিয়াটী রামকৃষ্ণ মিশন, নহবত খানা, শ্রী শ্রী মাধব গৌড়ীর মঠ ঢাকা, নিতাই গৌড়ের আখড়া, ইত্যাদি।
১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহন করেন এবং বর্তমানে এর সংস্কার কাজ চলছে। এ পরিবারের বংশধর বাবু কিশোরী লাল রায় ঢাকার জগন্নাথ কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।
**ঢাকার গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জ বা সরাসরি সাটুরিয়া যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। জনট্প্রতি ভাড়া পড়বে ৬০-৭০ টাকা। সাটুরিয়া পৌঁছে সেখান থেকে রিকশা বা লোকাল সিএনজিতে করে জমিদার বাড়ি যাওয়া যাবে। জনপ্রতি ভাড়া ১০টাকা।
**বালিয়াটি জমিদার বাড়ি রোববার পূর্ণদিবস আর সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে। অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও বন্ধ থাকে।
** জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য টিকেটের মূল্য জনপ্রতি ১০টাকা।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।