- হোম
- >
- শিল্প-সাহিত্য
- >
- বাঘ, বাঘদেবতা ও লোকসংস্কৃতি
বাঘ, বাঘদেবতা ও লোকসংস্কৃতি
বাংলার লোকজীবন বড়ো বিচিএ। আত্মরক্ষার জন্য মানুষ কী-ই না করে। জীবনধারণের জন্য মানুষকে পথে ঘাটে বনে জঙ্গলে, নদী নালায়, খেতে খামারে যেতেই হয়। আর সে সব স্থানেই বাস করে সাপ, বাঘ, হাতি, কুমির প্রভৃতি ভয়ঙ্কর জন্তুরা। যাদের এক ছোবলে কিংবা এক কামড়ে মানুষের সুনিশ্চিত মৃত্যু। তাই সেই আদিকাল থেকে বাংলার সাধারণ মানুষ সেই নব পশুদের ঘিরে নানা দেবতার কল্পনা করেছিল। যেমন সাপের দেবতা 'মনসা' হাতির দেবতা 'হাত খেদা,' বন্য মেষের দেবতা টাড়বাড়ো কুমিরের দেবতা কুমিরাও। তেমনি বাঘের দেবতা 'দক্ষিণা রায়' বা 'বাঘুৎ'। ভক্তদের বিশ্বাসে, এ দেবতা যেমনই হিংস্র ও প্রতিহিংসা পরায়ণ, তেমনি ভয়ংকর মেজাজি। প্রচন্ড তার ক্ষমতা। অখন্ড বাংলায় এই বাঘ দেবতা ছড়িয়ে আছেন। পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় তাঁর নাম 'বাঘুৎ' দক্ষিণা রায় বা ‘বড়ো গাজিখাঁ’।
উত্তরবঙ্গে তাঁর অনেকগুলি নাম ডুয়ার্স অঞ্চলে 'বীরবাঘ' জলপাইগুড়িতে স্থানে স্থনে নাম ‘মহারাজা ঠাকুর,’ ‘বাঘশুর', কানাইয়া 'কিংবা ফালাকাটারাজা' কোচবিহারে তার নাম ‘ডংধরা’ মেছসমাজে তার নাম ‘হাগড়ামাড়াই’ রাজবংশী সমাজে তার নাম ‘কুমীরদেব', কাঠুরে সমাজে তার নাম ‘শলেশ্বরী’। তেমনি পূর্ববঙ্গের রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, পাবনা অঞ্চলে তার বিখ্যাত নাম ‘সোনা রায়’ উত্তরবঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলেও এই নামটি প্রচলিত। পশ্চিম বাংলার বীরভূমে এক বাঘের দেবীর নাম ‘বাঘরাই চন্ডী’। সাঁওতাল সমাজে বাঘের দেবতার নাম ‘সীমা সাড়ে’ বা ‘গোঠসীম’। দক্ষিণবঙ্গেও এক বাঘের দেবী আছেন তার নাম ‘বনবিধি’। কোচবিহারে এক বাঘের দেবীর নাম ‘ভান্ডারী’। ময়মনসিংহের এক বাঘ দেবীর নাম ‘বিপদনাশিনী’। চট্রগ্রামে এক দেবতার নাম ‘শালপিন’। ‘বাঘরায়’ আছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের নানা স্থানে।
শুধু অখন্ড বাংলাতেই নয় ভারতের নানা স্থানে বাঘ দেবতা বর্তমান।
উত্তরপ্রদেশে এক বিখ্যাত বাঘের দেবতার নাম 'বাগশর', মধ্যপ্রদেশে তার নাম 'বাঘদেও'। আসামে এক বাঘদেবতার নাম ‘সাত শিবারী’ বিহারে তার নাম ‘বনরাজ’। শুধু ভারতেই নয়, ভারতের বাইরেও বাঘ দেবতা আছেন। নেপালে বাঘের দেবতার নাম ‘বাঘভৈরব’। তাকে অনূসরণ করেই বাঘযাএা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রাজপুতনায় এক বাঘের দেবতার নাম 'বাঘেল'।
তবে বাঘ দেবতার প্রাচীন রুপের সন্ধান মেলেনি। কারো কারো আধুনিক মূর্তি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রচারিত দেবতার নাম 'দক্ষিণারায়'। যাকে নিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি কৃষ্ণরাম দাস প্রমুখ রায়মঙ্গল রচনা করেছেন। ধপধপি গ্রামে দক্ষিণারায়ের একটি অনন্যসুন্দর মূর্তি বর্তমান। রাজকীয় তার বেশ। মাথায় মুকুট কানে কুন্তল, বিস্তৃত চোখ, উচু নাক, কুচকুচ মোটা গোফ, হাতে বন্দুক, তলোয়ার কিংবা এিশূল বা তীর ধনুক। ঠিক যেন রাজযোদ্ধা।
দক্ষিণ বঙ্গের কাঠুরে, শিকারী, পাটুনি বাগদি, মউলা, ধীবর, জেলেও মালঙ্গী প্রভুতি নানা শ্রেণির উপজাতির লোকেরা তার পূজো করে। প্রায় সর্বএই তাঁর বাহন বাঘ। ইদানিং দার নামে মন্ত্র হয়েছে। নানা নৈবেদ্য ও বলি দিয়ে পৌষ সংক্রান্তি বা ১লা মাঘ তার পুঁজো। সে সময় মেলা বসে। 'ব্যাঘ্রমঙ্গল' বা 'রায়মঙ্গল' ' গান হয়। বাঘ সেজে ছেলে ছোকরারা জনতাকে মুগ্ধ করে। দক্ষিণ রায় বিষয়ক যাএাপালা হয়। দক্ষিণ বঙ্গের আর এক রাগী বাঘ দেবতা 'বড়োগাজি খাঁ'। এঁরও বীরমূর্তি। মাথায় টুপি, লম্বা দাড়ি, আকর্ণ গোফ, গোলগোল দুটি চোখ দু পাযে বুটজুতো। এর যোদ্ধাবেশ। ক্ষিরের সিন্নি দুয়ে এর পূঁজো।
উত্তর বঙ্গের বিখ্যাত বাঘদেবতা 'সোনারায়'। বাঘের উপরে তিনি বসে থাকেন।পরণে মালকোঁচা ধুতি। একহাতে লাঠি এক হাতে গাঁজা কলকে। বিশাল বুক, পায়ে বুট। তাকে নিুয়ে প্রচুর পালাগান, ছুটকো গান। উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে আর এক বাঘবাহন দেবতার নাম কুমীরদেব। নামটি বড়োই আশ্চর্য। তাঁর ও চারটি হাত দু'হাতে ঢাল ও ধনুক। পরলে বাঘ ছাল। হাঁস, ডিম,পাঠা, পায়রা ইত্যাদি বলি এবং মুড়ি-চিড়ে দই এর নৈবেদ্য দার পুঁজো। গোপালপুর, মাসপালা প্রভুতি অঞ্চলে দ্বিভুজ বাঘদেবতা 'ডাংধরা', তার এক হাতে লাঠি' বা ডাং। ডুয়ার্সে বীরুবাঘের পূজো হয় চৈএ সংক্রান্তিতে। ডাংধরা ঠিক শিবের মতো দেখতে। মাথায় জটা ও সাপ। পরণে বাঘছাল। পাশেই তার বাহন বাঘ। এমনি করে অনেক বাঘের দেবতা নানা স্থানে পুঁজো পাচ্ছেন।
পশ্চিম সীমান্তে বাংলায় পুরুলিয়া জেলার প্রায় সর্বএ, বাকুড়া জেলার দক্ষিণ পশ্চিমাংশ, পুরো পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা এবং পশ্চিম বাংলার সংলগ্ন বিহার ও ওড়িশায় সর্বাধিক পুজিত বাঘ দেবতার নাম 'বাঘুৎ'। অন্তত পাঁচশ গ্রামে তার থান। বাঁকুড়া জেলার রাইপুর থানার ফুলকুসুমা মন্ডলডিহা, কাশুড়ি, রসপাল, শালপাতড়া, মেলেড়া, কমলপুর, মগুলকুলি, দুধ্যা, লেদরা, বড়াপচা, বরাগাড়ি, ঠাকুর বাড়ি, রানিবাঁধ থানার ফুলঝোর, ছেন্দাপাথর, বনলতা, পুরুলিয়া জেলার বন্দোয়ান, পুঞ্চা নামোপাড়া, লালমডিহি, কুচিয়া, মানবাজার এবং মেদিনীপুর জেলার বিনপুর, বাঁকড়া, এটলা, বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, শিলদা প্রভৃতি অঞ্চলে বাঘুৎ এর প্রচুর থান। শালতোড়া থানার বারকোণা গ্রামে যেখানে ভক্তদের প্রাত্যহিক সমাগম দেখার মতো। বাঘুৎ মেলাও হয়।
বাঘুৎ এর মূর্তিটি বিস্ময়কর। ১২ থেকে ১৬ইঞ্চি করে কয়েকটি বাঘ যেন সারিবদ্ধ দাঁত বের করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তাদের পা দেখা যাচ্ছে না। গোলগোল চোক, কাগুলি খাড়া। আবার কোনো কোনো বাঘুঃ - এর মূর্তি নিতান্তই প্রস্তর খন্ড, যাতে বাঘের দাঁত, চোখ মুখ, নাক, কান আঁকা।
প্রধানত কোনো পুরোনো গাছের গোড়ায় তাঁর অবস্থান। অতি সম্প্রতি উপাসকরা চাঁদা করে কোনো কোনো স্থানে খড়ের চালা তৈরি করেছেন। কোনো কোনো স্থানে ইট-সিমেন্টের ছোট ছোটে বেদীয়ও তৈরি হয়েছে। বেদী থাকলে বাঘদেবতা থাকেন বেদীর উপরে, দু-পাশে নীচে থাকে তাঁকে দেওয়া উপঢৌকনের মৃৎমূর্তি- হাতি ঘোড়া ইত্যাদি। অনুসন্ধান করে জানা গেছে, পশ্চিম সীমান্ত বাংলার বাঘ মূর্তিগুলি নির্মাণ করেছেন, পুরুলিয়ার কুমোরেরা। কোনো কোনো স্থানে পূজোর দিনে ডোকরা শিল্পীদের নির্মিত ধাতুর তৈরি বাঘও বসানো হয়।
বাঁকুড়া জেলার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত যুদ্ধা কর্মকার (৫৬) এমনই কিছু বাঘ মূর্তি নির্মাণ করেছেন। দক্ষিণ বাঁকুড়ার সাতটি বাঘ মূর্তি নির্মাণ করেছেন ফুলকুসম গ্রামের কাঠশিল্পগোবন্ধন সূএধর, মকরঞ্জনই এদেশে প্রথম কাঠের অভিনক ঘোড়ার নির্মাতা।
সারা দক্ষিণ বাঁকুড়ার সমস্ত অনুন্নত সমাজ তথা শ্রমিক মুনিষ শ্রেণি বাঘ দেবতার পূজো করে। পুজোরি বা লায়া হন পরুষানুক্রমে। তাঁরা নিজ নিজ সমাজ থেকে পূজোরি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোথাও ব্রাহ্মন পূজারি দেখেনি। পূজোর মন্ত্রও কিছু নেই। বছরে ছ-দিন দিন তাঁর পূজো-রোহিনী। (১৩ জোষ্ঠ), দশহরা, অম্বুবচী, ঝাঁপন-সংক্রান্তি (শ্রাবণের শেষ দিন) ডাক সং--(আশ্বিনের শেষ দিন) এবং এখান বা ১ মাঘ। তবে মানসিক থাকলে যে কোনো মঙ্গল বা শনিবারে তা শোধ করা যায়।
পূজোর নৈবেদ্য তেমন কিছুই নয়। কিন্তু ছাগ বা পায়রার রক্ত চাই- ই- চাই। তবে সঙ্গে চাই কোনো পশুর (ছাগি মেষ বা গাভীর) নির্জলা দুধ। ভক্তরা তাঁকে দই চিঁড়ে, গুড়পাটি ও গুড়ের নাড়ু দেয়। এখন পূজোতে প্রদীপ জ্বলছে, ধূপ পুড়ছে, ঘি, মধু, ফলমূল, এমনকি মিষ্টি ও থালায় থালায় সজ্জিত হচ্ছে। ছেঁদা পাথরের পূজোরি রঘুনাথ মাঝি (৫৪) বলেন, বাঘুৎ এর পূজোয় রক্ত চাই-ই-চাই। যদি কোন বছর কালো পশু-পাখি সংগ্রহ করতে না পারা যায়, তখন পূজোরিকেই তার বুক থেকে তিন ফোঁটা রক্ত দিতেই হয়।
রঘুনাথের বৃদ্ধবাব জানকীনাথ (৮০)। সারাজীবন ধরে বাঘুৎ এর পূজো করেছেন। রক্ত দেওয়ার কথায় তিনি বললেন-ই বড়ো কঠিন কাজ। রক্ত দিতে যে-সে লোক পারে নাই। তাই ঠাকুরের পূজারিই পাওয়া যায় নাই। আমি তো অনেককেই বলেছিলাম। শেষতক কেউ রাজি হয় নাই। জামাইও পারলেক নাই। বেটাই পারলেক'। বাঘুৎ কে ভক্তরা বাঘের অধিষ্ঠান দেবতা বলে মনে করে। 'মনসা যেমন সাপের সর্বময় কর্এী তেমনি বাঘুৎ ও সারা দেশের বাঘ সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। জানকীনাথের ভাষায় বাঘুৎ বড়ো জীবন্ত দেবতা। পূজোপাশা করে বনে গেলে সব নিশ্চিন্তি। বাঘের টিকিটি দেখা যায় নাই। তা নাহলে, রেতে বিরেতে এত বড়ো জঙ্গলটা একা ঘুরতে পারতেন নাই বাবু।
জীনকীনাথের মতোই অসংখ্য শিকারজীবী ও বনাঞ্চলবাসী বাঘুৎ সম্পর্কে এমনই উচ্ছাস প্রকাশ করে থাকেন। বনপাহাড়ি গ্রামের সুকাম ভূমিজ (৭৩) আরও মজার গল্প শোনান। তাঁর ভাষায় একবার বনে গেছি। জাঁকালে বন। গাছে উঠে মউ পাড়ছি। দেখি দাঁত গিজুডাটা গাছের তলে হাজির। মউমাছি গুলা কানগড়ায় ভঁ ভঁ করছে। এখনি কামড়াই দিবেক। আর নিচে দাঁত গিজড়াটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। অমনি আমার মনে পড়ে গেল। আমি তিন ফোঁটা মউ দাঁত গিজুড়ার দিকে ফেলে দিলাম। বললাম-হে বাবা, কালো মুরগি দিবো। দেখি সেটা সেরাঁই গেছে।
বাঘুৎ এর পূজোরি সমাজে আরও নানা বিশ্বাস। তাঁর যদি ভালো করে পূজো দেওয়া যায়, তাহলে মানুষ কেন, কোনো পশুকেই বাঘে খাবে না। তাঁকে দুধ মানসিক করলে গাভীন গাই, গাভীন ছাগলগুলো ঠিকঠাক পসব করবেক। ছানাগুলোও ভালো থাকবেক। তিনি সন্তুষ্ট হলে কোনো গোরু, ছাগল, তার বাগালে, কারো কিছুটি হবেক নাই। তাঁর পূঁজো দিতে কত মরণমুখী পশু বাঁচে গেছে। তাই কোনো ভক্ত বাঘুৎ এর পূজোর ফুল মাদুলি করে পশুদের গলায় ঝুলিয়ে দেয় কেউ বা গোয়ালে টাঙিয়ে রাখে। কেউ কেউ বিশাল উপকারের আশায় কিংবা উপকার পেয়েছে এমন বিশ্বাসে বাঘুৎ এর নামে ‘বদা’ (পাঠা) ছাড়ে। নিদির্ষ্ট দিনে সেই পাঠাকে বলি দেওয়া হয়।
বাঁকুড়ার ছেঁদপাথর অঞ্চলে ফুলঝোর একটি অনন্য ঝরণাধারা। অসংখ্য মানুষ সেই ঝরণার জল পান করে। ঝরনার পাশেই আছে এ প্রস্তর রুপী বৃহৎ 'বাঘুৎ'। তিনি কোনো রক্তই চান না। পথচারীর কাছে তিনি সম্মান চান। তাই একটি করে ছোটো প্রস্তরখন্ড দিলেই তিনি সন্তুষ্ট। তাই ভক্তরা তাঁর থানের পাশে সুদীর্ঘকার ধরে একটি করে পাথর দিয়ে গেছে। একসময় তা একটি ছোটো পাহাড়ের মতো উঁচু হয়েছিল। পরকর্তীকালে ‘বন বাবুরা' আকস্মিক পাথরগুলিকে চালান করে দেয়। এই ঘন গভীর জঙ্গলে কারো গোরুর গাড়ির 'লিঘা' ভাঙ্গলে বা চাকর ‘বেড়’ খুলে গেলে, বা গোরু মোষের অসুখ করলে, ভক্তরা তাঁর নামে তামাকু দেয়। এই বাঘুৎ 'গুটি-বাঘুৎ' নামে পরিচিত। গুটি মানে গোল পাথরখন্ড।
বাঘুৎ সম্পর্কে নানা সমাজে নানা লোকবিশ্বাস। তাঁকে নিয়ে নানা লোকগাথা। বাঁকুড়ার রাইপুর থানার কমলপুরে একটি পশুপালক সম্প্রদায়ের নাম রাজোড়। ‘রায়' এদের উপাধি। এরা বাড়িতে বাড়িতে গাভী পালন করে। পাশের গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে দুধ দেয়। এদের পারিবারিক দেবতা বাঘুৎ। প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই সিজ মনসার গাছ আছে। তার তলায় বাঘুৎ পূজো পান হাতি ঘোড়া রুপে। নির্জলা দুধই তাঁর নৈবেদ্য। রক্তে লাগে না। আবার মোট পঁচিশ মিলে এরা ‘এখ্যান' দিনে এর সাড়ম্বর পূজো করে। পিঠে দেয়। পিঠে বলতে সিম- পিঠে, লাউ পিঠে, মাছের পিঠে, ছাগল- মাংসের পিঠে। অধুনা কাঁকরা পিঠেও দেওয়া হচ্ছে। ‘গড়গড়ে' বা ‘পুরপিঠে’ তো থাকেই। একদা ১ মাঘ এদের সমাজের মুরুব্বিরা শিকারে বেরোতেন। এই সমাজের বর্ষীয়ান মানুষ কেশবচন্দ্র রায়, মানিক রায়, শম্ভু রায় প্রমুখ একযোগে বলেছেন, বাঘুৎ ভীষণ রাগী ঠাকুর। দুধে জল মিশলেই তিনি সর্ব্বনাশ করে ছাড়বেন। তাই গ্রামের রাজোড় সম্প্রদায় কখসও দুধে জল মেশায় না। এই সম্প্রদায় এখন পশুপালন বৃত্তি ছাড়ার মুখে। কিন্তু যারাই দুধ বিক্রি করে, তাদের দুধ সত্যি সত্যিই একটু আলাদা।
মেদিনঅপুরের ওঁড়গোন্দা, কাঁকড়াঝোর, চাঁদাবিলা, দুবড়া, গুণনিবাসা এবং বাঁকুড়া জেলার মন্ডুলডিহা, নামোশোল, কালিপাথর, দুবলালা প্রভৃতি অঞ্চলে আরেকটি পশুপালক সম্প্রদায়ের নাম বাগাল'। এদের পদবী আহির। এদেরও অনেক ঘরে বাঘুৎ পূজো পান। এদের সমাজে বাঘুৎ নিয়ে একটি চমৎকার লোকগাথা প্রচলিত আছে ভগবান কৃষ্ণ। তাঁর বৃত্তি গোধন পালন। গোটা দিন তিনি ঘুরে ঘরে গোরু চরান। একদিন প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে ভাবলেন এখন গোরু রাখার জন্যে একটা 'বাগাল' দরকার। ওমনি তিনি ঘর্মাক্ত দেহ থেকে এক টুকরো মলা (ময়লা) বের করলন। তাকে ঘসে মেজে প্রাণ দিয়ে মানুষ করলেন। নাম দিলেন 'বাগাল'। বাগালকে কৃষ্ণগরু চরাতে বললেন। কিন্তু বাগার বলল, সে সব পারবে, কিন্তু বাঘের আক্রমণ রোধ করতে পারবে না। সে কৃষ্ণ কাছে 'সাতদামড়া' (সাত বলদের) বল চাইল। কৃষ্ণ বললেন, বেশ কাল তুই ভোরে আসিস। আমি তোকে বর দেব। বাঘ আড়াল থেকে সে কথা শুনে ফেলল। বাগালের আগেই বাঘটা কৃষ্ণকুঞ্জের দাওয়ায় এসে নানা শব্দে নিজের উপস্থিতি জ্ঞাপন করল। ঘুমের ঘোরে কৃষ্ণ তাকেই বাগাল ভেবে সাত দমড়া বলের বর দিলেন। বাঘ আনন্দে আটখানা হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেল। একটু বেলা হতেই বাগাল এল। পথেই বাঘের মুখে সে ব্যাপারপা শুনে কেঁদে ফেলল। কৃষ্ণ কাছে এসে সে কাঁদতে লাগল। কৃষ্ণ তাকে বললেন তুই 'বাঘুৎ' এর পূজো কর। তোর কোনো অনিষ্টই হবে না। সেই থেকে বাগাল সমাজে বাঘমুখী 'বাঘুৎ এর পূজো।
বাঘুৎ পূজো আসলে পশু পূজো। আদিম মানুষ যখন বনে জঙ্গলে বাস করত, তখন থেকেই 'বাঘুৎ' পূজোর চল। এক সময় শুধু বনে নয়, গ্রামে গ্রামে কত মানুষকে যে বাঘ মেরেছে, তার কেউ হিসেব রাখতে পারেনি।
শিকার নির্ভর পশুপালক সমাজ বাঘের ভয়ে সর্বদাই সন্ত্রস্ত ছিল। পশুশক্তির এই ভয়ঙ্করতাকে সেই অজ্ঞ ও ভীত মানুষ দেবতা বলেই ভেবেছিল। নরখাদক যে বাঘ, তার ভেবেছিল তার পশুমূর্তির ভিতরে এক শক্তিধর দেবতা। বর্তমান এবং তাতেই সুপ্রাচীন ভরতে বাঘ বিষয়ক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। তার প্রমাণ আছে মহেন্জুদাড়ো-হরপ্পায় আবিষ্কৃত অনেকগুলি বাঘাচিএ সম্বলিত শিলমোহর। একটি শিলমোহরে আছে একটি একক ছবি। একটিতে আছে এক বাঘবাহনা নারী। আর একটিতে আছে একটি গাছের তলায় দু-দিকে দুটো বাঘ। এই বাঘ বাহনা নারীই সম্ভবত সেকালের বাঘের দেবী।
বেদেও বাঘের কথা আছে। ঋকবেদে ঋষি প্রার্থনা করছেন। (৬/৫৪/৭), তাঁদের গোধনগুলি যেন বাঘের দ্বারা নিহত না হয়। কখনো বা (১০/১২৭/৬) ঋষি প্রার্থনা করছেন- `হে জননী রাএি, তুমি আমাদের বাগ বাঘিনীদের থেকে দূরে রাখো। অথর্ব বেদে ও তৈত্তিরীয়- সংহিতায় বাঘের কথা আছে। মহাভারত বুদ্ধজাতক ও তন্ত্রশাস্ত্রে বাঘের প্রসঙ্গ বর্তমান। সাঁওতাল উপকথা ও লোকসাহিত্যে নানা গানে ও গাথায় বাঘের উপস্থিতি ঘটেছে।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাঘের কথা তো আছেই। পঞ্চদশ শতাব্দীর 'মনসা বিজয়' এর কবি বিপ্রদাস পিপিলাই, তাঁর কাব্যে বাঘের জন্মকথা বলেছেন। ষোড়শ শতকের মুকুন্দ রাম চক্রবর্তীর কাব্যেও বাঘের কথা পাই। সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি মাধব আর্চায কৃঞ্চরাম দাস, হরিদেব, রুদ্রদেব এবং উনবিংশ শতাব্দির কবি রতিরাম দাস, বনমালী দাস প্রমুখ বাঘ দেবতাকে নিয়ে ‘বাঘমঙ্গল কাব্য’ লিখেছেন। সেগুলি হয়তো মঙ্গলকাব্যধারায় খুব উল্লেখযোগ্য স্থান পায়নি, কিন্তু তার কোনো কোনো অংশ অবশ্যই উদ্বার যোগ্য।
কবি বলেছেন-
দক্ষিণ রায়ের বারা ঝারা মাথায় করিয়া।
কৃঞ্চরাম করি গায় দক্ষিণ রায় ভবিয়া।।
লোকসাহিত্য বাঘের অনেক কথা। বাঁকুড়ার টুসু গানে আছে –
সনাগাড়ায় দেখে এলাম সনার পিঁড়ায় বাঘ বসে।
সে বাঘ কি মানুষ মারে বাঘঠাকুর যে রং দেখে।।
একটি বাঘগীতিতে শুনি-
খেও না খেও না বাঘ রে
খেও না খেও না মোর পতিরে
বনের বাঘ তুমি, বাঘ রে
হাতে ধরি পায়ে ধরি রে
অ বাঘ ছেড়ে দাও মোর পতিরে
বনের বাঘ তুমি, বাঘ রে।
বাঘকে নিয়ে এদেশে কত না গল্প, কত না কাহিনী। বাঘ নিয়ে এদেশে শিল্পকর্মও কম নেই। ভাদুলী ব্রতের আলপনায় বাঘের চিএ। দালানের প্রবেশ মুখে খিলানো বা স্তম্ভে বাঘের মুখ। কোনো কোনো কার্ণিশে বাঘ ও সিংহের সম্মিলিত মূর্তি 'শার্দুল সিংহ'। মেদিনীপুর ও বীরভূমের পটেও বাঘমূর্তি চিএিত।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।