রাজকন্যার জন্য পৃথিবী
ঘটনাদু’তিন দিন আগের। আমি ঢাকায় যেখানে থাকি ঢাকার অধিকাংশ বাসাবাড়ির মতো এখানেও এই বাসা ঐ বাসার জানালা মুখোমুখি। অর্থাৎ একজনের জানালা খুললেই আরেকজনের বেডরুম দেখা যায় এরকম। ঢাকায় সচরাচর যেমন হয়। গত বছরের জুন থেকে আমি পাকাপাকিভাবে ঢাকায় আছি। প্রায় একবছর হতে চলেছে। যদিও এর অনেক আগে থেকেই ঢাকায় যাতায়াত। আর সেই তখন থেকেই দেখে আসছি, এখানে মুখোমুখি জানালা থাকলেও কেউ কারো সাথে কথা বলে না। চোখাচোখি হলে চোখ সরিয়ে নেয়। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে মানুষগুলো বছরের পর বছর থাকে। কিন্তু জানতেও পারে না তারা কে। চেষ্টা করে যতদূর সম্ভব সংসর্গ এড়িয়ে চলা যায়। এই নতুন বছরে যেখানে এসে উঠলাম, সেখানেও। আমি বরাবরই আলো-বাতাস, খোলামেলা প্রিয় মানুষ। আমার জানালার পর্দা তাই সবসময় উঠানো থাকে। কিন্তু এখানে আশেপাশের সবগুলো বাসায় জানালার কাঁচ সবসময় আটকানো। তার উপর ভারী পর্দা দেয়া।
এক্ষেত্রে নিজের একটা অভিজ্ঞতা আগে বলি। তিন বছর আগে বোন ঢাকায় যেখানে থাকতো, সেখানে এসেছিলাম। রান্নাঘরে মুখোমুখি জানালা। ওপাশের রান্নাঘরে মহিলা সবজি ধুতে ধুতে একনাগারে কথা বলে যাচ্ছেন। মেয়ে স্কুলে যাবে তার জন্য খাবার তৈরী হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সেই স্কুলপড়ুয়া মেয়ে নিজেই হাজির হলো। বয়স ৬ বা ৭ হবে। বয়সের স্বভাবেই দুষ্টুমি করছিল। আর আমি সেটাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। এই ব্যাপারে যারা আমাকে জানেন না তাদের জন্য আরেকটা কথা বলে রাখি। পৃথিবীতে যে বিষয়টি আমাকে সবসময়ই আনন্দ দেয় তা হচ্ছে শিশু। আমি যত কষ্টেই থাকি, যত ঝড় আমার উপর দিয়ে যাক, একটি শিশুর হাসি আমার মন ভালো করে দিতে যথেষ্ট। আর এদের সংসর্গে আমি কখনোই বিরক্ত হই না।
যাই হোক, যা বলছিলাম, আমি যখন খুব আনন্দ নিয়ে মেয়েটির উচ্ছলতা দেখছিলাম ঠিক তখনই তার মায়ের দৃষ্টি পড়ে আমার প্রতি। আর আমি যে তার মেয়ের দিকেই তাকিয়ে আছি তা বুঝতে তার এক মুহুর্তও লাগেনি। বুঝতে পারার সাথে সাথেই তিনি আমার দিকে যে দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন তাতে রাবণের পুরো লঙ্কাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া সম্ভব। নিতান্তই ভালো মানুষ বিধায় হয়তো তিনি আমাকে কিছু না বলে সেই আগ্নেয়গিরির পুরোটাই ঐ বাচ্চা মেয়েটির উপর ঢেলে দিয়ে তাকে রান্নাঘর থেকে বিদায় করে দিলেন। আমার কারণেই যে মেয়েটিকে এহেন অমানবিকতার শিকার হতে হল তা বুঝতে আমার দেরী হয়নি। এরপর থেকে ঐ বাসা তো দূর আমি মুখোমুখি জানালার আর কারো দিকেই তাকাইনি।
মূল ঘটনায় আসার আগে আমার মনে হয় এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং একই সাথে অপ্রিয় বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষ। অনেকের মনেই খটকা থাকতে পারে কোন বিষয় একই সাথে প্রিয় এবং অপ্রিয় হয় কি করে? আমি মানুষকে জানতে ভালোবাসি, মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসি। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ কি করে, তার সেই সাইকোলজি পর্যবেক্ষণ করা আমার কাছে অত্যন্ত মজার একটি বিষয়। মানুষ সম্পর্কে আমার আগ্রহের কমতি নেই। আমি যেখানেই যাই, আশেপাশের সব উঁচু উঁচু বিল্ডিং এর সারির দিকে চোখ বুলাই। বিল্ডিং এর পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠা বস্তির দিকে তাকাই। আর কেবলই ভাবি, ঐ বস্তির মানুষগুলো কেমন? ঐ দূরের বিল্ডিং এ ঐ যে জানালায় লাইট জ্বলে তারা কেমন?
আমার অন্যতম প্রিয় একটি কাজ হচ্ছে রাস্তার এক কোণায় দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে আশেপাশের সব মানুষের কর্মকান্ড দেখা। আর এটা করতে করতে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারি। কথা হচ্ছে তাহলে অপ্রিয় কেন বা কিভাবে? মানুষগুলোকে জানতে পছন্দ করি, কিন্তু জানার পরেই মানুষগুলো আমার কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠে। যে মানুষগুলোকে আমি শ্রদ্ধার আসনে বসাই, আমি দেখি তারা একেকজন অণুজীবের চেয়েও ছোট। আমি যাদের ভালোবাসি, দেখি তারা তেলাপোকার চেয়েও কদর্য। সবার কথা বলছি না। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ ভালো বা খারাপ হয় না। মানুষ শুধু দুই প্রকার হয়, সৎ এবং অসৎ। একজন মানুষের পক্ষে যদি তার ভেতরের সকল কুপ্রবৃত্তি স্বীকার করার সততা থাকে আমি তাকে দশে দশ দিবো। কিন্তু আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি, মানুষের মাঝে এই সততারই বড্ড অভাব। আমি খারাপ মানুষ সহ্য করতে পারি, কিন্তু ভন্ডামি সহ্য করতে পারি না।
যাই হোক এবার মূল ঘটনায় আসি। দু’তিন দিন আগে রাতে জানালার পাশে ডেস্কটপে বসে কাজ করছি। যেহেতু পূর্বে উল্লিখিত ঘটনার কারণে আমি আগেই মুখোমুখি জানালায় তাকানো বন্ধ করে দিয়েছি, তাই মনোযোগ সহকারে কাজই করে যাচ্ছিলাম। হঠাত করেই মনে হল, কোন এক রাজকন্যা যেন আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে উপরে তাকাতেই দেখি, সত্যি, পাশের বাসার মুখোমুখি জানালায় গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ৩/৪ বছরের একটি মায়াবী শিশুকন্যা। আমি তাকানো মাত্রই সে ফিক করে হেসে পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর টের পেলাম আবার। আবার তাকাতেই হাসি দিয়ে ছুট! বুঝলাম সে মজা পেয়েছে, এখন এটা তার কাছে খেলা। আমিও সব ভুলে তার খেলার এক সঙ্গী হয়ে গেলাম। সে জানালায় আসে, আমি তাকাই, সে হেসে দৌঁড় দেয়। কখনো পর্দার আড়াল থেকে একটু তাকায়, আমি উঁকি দিলেই চলে যায়। আবার কখনো আমি তাকালেই দুই হাতে মুখ ঢেকে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। আবার কখনো কিছু একটা নিয়ে এসে সেটা তার চোখের সামনে ধরে রাখে। ভাবখানা এমন, সে যেহেতু আমাকে দেখছে না, আমিও নিশ্চয়ই তাকেও দেখছি না।
আমি এমনিতেই শিশুবৎসল, তার উপর এই শিশুটির এমন মায়াবী হাসি, একই সাথে ঢাকা শহরে প্রথম এমন অভিজ্ঞতা, আমি ভীষণ উপভোগ করছিলাম। এভাবে প্রায় মিনিট দশেকের মতো গেল। তখনো তার আশেপাশের কেউ বুঝতে পারেনি সে আমার সাথে এমন খেলায় মেতে উঠেছে। এমন সময় বাধ সাধলো আরেক শিশুকন্যা। তার বয়স ৮/৯ বছর হবে, হয়তো তার বোন। সে একটু বড় হয়েছে তাই হয়তো এই শহরের নিয়মকানুন শিখে গিয়েছে। ছোট্ট শিশুটি আমার সাথে এরকম করছে টের পেয়েই বড় কন্যাশিশুটি এসে তাকে টেনে নিয়ে গেল এবং জানালার পর্দা টেনে দিল। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আর পুনরায় কাজে মন দিলাম।
ঢাকা শহরে এসে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাথে সাংবাদিকতা শুরু করি। যেহেতু স্কুলজীবনে করেছি তাই ব্যাপারটা আমার কাছে খুব কঠিন ছিল না। তবে কষ্টকর ছিল বৈকি। কারণ আমার কাজটা ছিল নারীদের নিয়ে। প্রতিদিন ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পিতার হাতে কন্যার ধর্ষণ, ৬ মাসের শিশু ধর্ষণ, ২ বছরের শিশুর উপর পাশবিক নির্যাতন এসব সংবাদ আমাকে দেখতে হতো, আর আমার হাত কেবলই মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে উঠতো ঐসব জানোয়ারদের পিষে ফেলার জন্য। নতুন আরেকটি কাজ শুরু করেছি একেবারেই নিজে, ‘জাগরণীয়া’। এর কাজ করতে গিয়ে যেন আরো আরো কদর্য বিষয়গুলো সামনে আসছে। আমি আমার ডেস্কটপে কাজে মন দেয়ার পর এই সবগুলো কথা আমার মনে পড়ছিল। আমি কাউকে দোষ দিতে পারিনি তাই। মানুষ কেন আত্মকেন্দ্রিক হবে না? মানুষ কিভাবে মানুষকে বিশ্বাস করবে? একটি দুই বছরের শিশু যার কোন লিঙ্গানুভূতিই গড়ে উঠে না তাকে যদি ধর্ষণ করে তারই কোন আত্মীয়, ভাই কিংবা অন্য কেউ, আর তাতে যদি সহায়তা করে অন্য কোন নারী, আমি কি করে আশা করবো মানুষ মুখোমুখি জানালার কাউকে বিশ্বাস করবে?
শুভ্রা করঘটনা ওখানেই শেষ হয়ে গেলে হয়তো আমি এখানেই পরিসমাপ্তি টেনে দিতাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মিনিট পাঁচেক পর সেই ছোট্ট রাজকন্যা আবার ফিরে এলো। এবার একা না, সাথে সেই বড় রাজকন্যাও আছে। ছোট রাজকন্যা পর্দা সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, আমিও হাসলাম। সাথে সাথে সে বড় রাজকন্যার দিকে তাকিয়ে বললো, দেচ্ছো, ও পতা না (দেখছো, ও পঁচা না)। আমার চোখে পানি চলে আসলো।
ছোট রাজকন্যা বেঁচে থাকুক। মানুষের উপর মানুষের বিশ্বাস তারা আবার ফিরিয়ে আনুক। এই ছোট রাজকন্যাদের জন্যই মানুষকে অমানুষের রাজ্য থেকে ফিরিয়ে আনা খুব প্রয়োজন। আমি চাই না এই ছোট রাজকন্যারা কখনো বলুক, তুমরা তবাই পতা।
সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা বলে, খুব বড় লিখা মানুষ পড়তে চায় না। কেউ যদি ধৈর্য্য নিয়ে পুরো লিখাটি পড়ে থাকেন তাহলে ধন্যবাদ। দয়া করে এই ছোট রাজকন্যাদের জন্য কিছু করুন। আমরা বড় বেশি অমানুষ হয়ে যাচ্ছি দিনদিন।
লেখক: প্রকৌশলী ও সাংবাদিক
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।