শেখ রাসেল স্মৃতি বিদ্যালয় ও জমি দখল !
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ রাসেলের নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় দখল করে নাম পাল্টিয়ে দিয়েছে একটি প্রভাবশালী চক্র। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ঘটেছে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার হেলিপ্যাড এলাকায়। দিবালোকে কমান্ডো স্টাইলে শহীদ শেখ রাসেল স্মৃতি বিদ্যালয় ভাঙচুর ও সাইনবোর্ড পাল্টিয়ে ‘কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিলেও পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করেছে ঘটনার ৪দিন পর।
শেখ রাসেল বিদ্যালয়ের ৫১ শতক জমি বেদখল এবং বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের অভিযোগ বিষয় সচিব শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের স্বারক নং ২০১৩-৭২(২) সুত্রে পত্রের নির্দেশও উপেক্ষা করা হয়েছে। এ ঘটনায় এলাকায় চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
জানা যায়, জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পশ্চিম নাগেশ্বরীর হেলিপ্যাড এলাকায় স্থানীয় দানবীর বীরমুক্তিযোদ্ধা ননী গোপাল বর্মণ, বাবুল কুমার বর্মণ, হাছেনা খাতুন, আফছার আলী ও ভোটকা শেখ মিলে ২০০০ সালে ৫১ শতক জমি ‘শহীদ শেখ রাসেল স্মৃতি বিদ্যালয়’ নামে দানপত্র করে দেন ।
সে বছরই বিদ্যালয়টি পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০১ সালে জমিদাতা ননী গোপাল বর্মণ বিদ্যালয়ের জমিদান সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে খুন হন। এ ঘটনার পর স্কুলের পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই ক্ষমতায় আসে চারদলীয় জোট সরকার। প্রভাবশালী একটি চক্র ওই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দখল করে নেয় শহীদ শেখ রাসেল স্মৃতি স্কুল ঘর ও জমি। ভয়ভীতি ও টাকার বিনিময়ে তৈরী করে নকল দলীল ও কাগজপত্র।
শেখ রাসেলের স্মৃতি মুছে ফেলে নামকরণ করা হয় কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে ২০১১ সালে এই স্কুলের নামে নেয়া হয় একাডেমিক স্বীকৃতি। এরপরই শুরু হয় তোলপাড়। হতবাক হয়ে যায় স্থানীয় প্রশাসন, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও এলাকার সাধারণ মানুষ। সবার একই প্রশ্ন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিয় ছোট ভাই শেখ রাসেলের নামে স্কুল ঘর ও জমি কিভাবে দখল করে নেয় ভুমিদস্যুরা। তাদের খুঁটির জোড়ই বা কোথায়।
শেখ রাসেল স্মৃতি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কাজী লতিফুল কবির অভিযোগ করেন, ১৯৯৯ সালে শেখ রাসেল স্মৃতি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০১ সালে মুল জমিদাতা ননী গোপাল খুন এবং চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন মামলার কারণে তিনি আত্মগোপন করেন। এই সুযোগে আজগার আলী, বাসারত, শাহালম মাস্টার, ও মোশনে আরা মঞ্জুসহ একটি চক্র ৫১ শতক জমিসহ স্কুলঘর দখল করে।
এরপর স্কুলের প্রায় ১৮ শতক জমি দখল করে নেয় স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা মজিবর রহমান বীরবল। রাসেলের স্মৃতি মুছে দিয়ে নামকরণ করা হয় কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ২০১২ সালে স্থানীয় অধিবাসীদের সহযোগিতায় পুনরায় রাসেল স্মৃতি বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এরপর আবার নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেন চক্রটি।
চলতি বছর ২০ মার্চ আকস্মিকভাবে নাগেশ্বরী পৌর মেয়র আব্দুর রহমান, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা মজিবর রহমান বীরবল, উপজেলা সমাজসেবা অফিসার সাদেকুল ইসলাম, আজগার আলী, কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোশনে আরা মঞ্জুসহ বেশ কিছু বহিরাগত সমঝোতার কথা বলে স্কুলে বসে। এক পর্যায়ে তাদের উপস্থিতিতে সন্ত্রাসীরা স্কুল গৃহ ও সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে শেখ রাসেলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে ঐদিন নাগেশ্বরী থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও পুলিশ তা আমলে নেয়নি।
এ ব্যাপারে নাগেশ্বরী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রশীদ অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে জানান, ২৪ মার্চ এজাহার গ্রহণ করা হয়। ৩০ মার্চ এস.আই সেলিম তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এ ব্যাপারে রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়া হবে।
কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোশনে আরা মঞ্জু জানান, ২০০২ সালে নোটারী পাবলিক-এ এফিডেভিট করে শেখ রাসেল স্মৃতি বিদ্যালয়ের পরিবর্তে কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৪ সালে পাঠদানের অনুমতি ও ২০১১ সালে একাডেমিক স্বীকৃতি দেয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড। ‘আমি মজিবর রহমান রীববল ও পৌর মেয়র আব্দুর রহমানের নির্দেশমতো সব উদ্যোগ নিয়েছি। অথচ এক সময়ে প্রধান শিক্ষক কাজী লতিফুল কবির এই বিদ্যালয়কে ধ্বংস করতে একের পর এক চক্রান্ত করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় থানায় মামলাও করেছে। তবে তিনি সাংবাদিকদের স্কুলের নামে বৈধ জমি ও অন্যান্য কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
আওয়ামী লীগ নেতা মজিবর রহমান বীরবল স্কুলের জমি আত্মসাতের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শেখ রাসেল স্মৃতি বিদ্যালয়ের নামে ননীগোপাল ও তার ভাই ৩৩ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়। এর বাইরে কেনা ১৮ শতক জমি আমি আমার নিজ নামে নিয়েছি। স্কুলের নামে নয়। ব্যক্তি নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রতিষ্ঠানের নামে ৩ লাখ টাকা জমা করতে হয়। সেই টাকা না থাকায় পরবর্তীতে স্কুলের নাম পরিবর্তন করা হয়। ব্যবস্থাপনা কমিটি রেজুলেশনের মাধ্যমে এ জমি কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামে দেয়। এছাড়া ননি গোপালের ছেলে ও ছোট ভাই ২০০২ সালে ওই জমি পুনরায় কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে লিখে দেয়।
নিহত ননী গোপালের ছোট ভাই বাবুল কুমার বর্মণ জানান, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ রাসেলের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আমরা দুই ভাই ২০০০ সালে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে জমি দান করি। বিদ্যালয়ের কার্যক্রমও শুরু হয়। কিন্তু এরই মধ্যে আমার ভাইকে খুন করা হয়। এ ব্যাপারে মনোজ বাণিয়া, বাবলু বাণিয়া, সোলেমান কসাইসহ অজ্ঞাতদের নামে থানায় অভিযোগ করি। উল্টো চাপ সৃষ্টি হয় আমার উপর। এরই মধ্যে বিএনপি নের্তৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। শুরু হয় নানাবিধ চাপ। পরে ২০০২ সালে আমাকে এবং আমার ভাই ননী গোপালের নাবালক পুত্র খোকনের কাছ থেকে জোড় পূর্বক স্টাম্পে স্বাক্ষর নেয় কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাথে জড়িত লোকজন।
নাগেশ্বরীর পৌর মেয়র আব্দুর রহমান স্কুল নিয়ে বিরোধের কথা স্বীকার করে জানান, ২০ মার্চ বিষয়টি তদন্ত করতে উপজেলা সমাজসেবা অফিসারকে নিয়ে স্কুলে যাই। শেখ রাসেলের পক্ষে কাগজপত্র দেখাতে না পারায় সাইনবোর্ড খুলে নতুন সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে ‘শহীদ শেখ রাসেল স্মৃতি নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ এর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও নাগেশ্বরী পৌর মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের কমান্ডার নুর মোহাম্মদ জানান, বিদ্যালয়টির নামে বৈধ দলিলপত্র থাকার পরও পৌর মেয়র আব্দুর রহমান ও মজিবর রহমান বীরবল ওই এলাকার জনৈক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী মোশনে আরা মঞ্জুকে প্রধান শিক্ষক দেখিয়ে স্কুলটির ভুমি দখলের অপচেষ্টা করছে। তারা গুণ্ডা বাহিনী দিয়ে তান্ডব চালিয়ে স্কুলের আসবাবপত্র ভাঙচুর ও সাইনবোর্ড ভেঙ্গে ফেলে।
কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম জানান, কামারপাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।