- হোম
- >
- উপ-সম্পাদকীয়
- >
- আমার দেখা গণজাগরণ মঞ্চ
আমার দেখা গণজাগরণ মঞ্চ
সবারই নিশ্চয়ই সেই দিনটির কথা মনে আছে। কাদের মোল্লার বিচারের রায় হয়েছে, সব অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। যে কোন একটা অপরাধের জন্যই দশবার করে ফাঁসি দেয়া যায় কিন্তু কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সারাদেশের সকল মানুষের ভ্রু এক সঙ্গে কুচকে গেল, তাহলে কি এই পুরো বিচারের বিষয়টা আসলে একটা প্রহসন? নাকি বিচারকদের ভেতরে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব? সরকার কি যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে আন্তরিক? আমাদের বয়সী মানুষের লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া করার কিছু নেই। তাই আমরা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলাম।
কিছুক্ষণের মাঝে আমার অফিসে ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করল। তারা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে থাকতে রাজি নয়। আমার কাছে জানতে চায় কি করবে। আমি জানি তরুণদের ভেতরে যখন ক্রোধ ফুঁসে ওঠে তখন সেটাকে বের করে দেয়ার একটা পথ করে দিতে হয়। তাই কিভাবে তারা তাদের ক্রোধটাকে বের করবে জানে না- আমিও জানি না। তারা নিজেরাই একটা পথ বের করে নিল, যখন বিকেল গড়িয়ে এসেছে তখন দলবেঁধে ক্যাম্পাসে স্লোগান দিতে শুরু করল। আমি ভাবলাম এখন হয়ত তাদের ক্রোধটা একটু প্রশমিত হবে।
আমি তার মাঝে খবর পেতে শুরু করেছি- ঢাকার শাহবাগে কিছু তরুণ এসে জমা হয়েছে, তারা দাবি করছে যতক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীর সঠিক বিচার না হবে তারা ঘরে ফিরবে না। শুনে আমার বেশ ভাল লাগল তারা সরকারের কাছে দাবি করে যুদ্ধাপরাধীদের সত্যিকারভাবে বিচার করে ফেলতে পারবে সে জন্য নয়। এই দেশের তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে এত তীব্রভাবে অনুভব করতে পারে সেই বিষয়টি আমার জন্য নতুন এক ধরনের উপলব্ধি।
এর পরের বিষয়গুলো খুবই চমকপ্রদ। শাহবাগে হাল্কা কয়জন মিলে যে জমায়েত শুরু করেছে, দেখতে দেখতে সেটি নাকি বড় হতে শুরু করেছে। খুব দ্রুত আমরা জেনে গেলাম শাহবাগ লোকে লোকারণ্য আমরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করতে থাকি। আমাদের সবার ভেতরে এক ধরনের কৌতূহল, এক ধরনের উত্তেজনা। আমার বাসায় টেলিভিশন নেই, তাই সরাসরি টেলিভিশনে দেখতে পাচ্ছি না, খবরের কাগজে ইন্টারনেটে খবর নিই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তরুণদের এই মহাসমাবেশটি নিজের চোখে দেখার খুব আগ্রহ ছিল কিন্তু আমি জানি সেটি হয়ত আমার কপালে নেই। আমি সিলেটে থাকি, ঢাকা যেতে যেতে এখনও কয়েকদিন বাকি, যখন ঢাকা পৌঁছাব ততদিনে হয়ত এই সমাবেশটি শেষ হয়ে যাবে। কোন জমায়েতই তো আর দিনের পর দিন থাকতে পারে না।
সিলেট থেকে আমি ঢাকা রওনা দিয়েছি ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ। আমার কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল- তখনও সমাবেশটি টিকে আছে। কোনমতে ধুকধুক করে টিকে নেই খুব জোরেশোরে টিকে আছে। আমার মনে হলো আমি হয়ত গিয়ে তরুণদের এই মহাসমাবেশটি নিজের চোখে দেখতে পাব।
রাতে গাড়ি করে আসছি তখন দেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন এ রকম মানুষজন আমাকে ফোন করতে শুরু করলেন। সবারই এক ধরনের কৌতূহল। যারা এই বিষয়টি শুরু করেছে তারা কারা? আবছা আবছা শুনতে পেলাম তারা নাকি এক ধরনের ব্লগার। এবার আমার একটু অবাক হওয়ার পালা। মাত্র কয়দিন আগে আমি পত্রিকায় একটা ছোট প্রবন্ধ লিখেছি। নেটওয়ার্ক প্রজন্মকে সেখানে হাল্কাভাবে দোষ দিয়ে বলেছি, তোমরা ফেসবুকে লাইক দিয়ে তোমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেল, কখনও তার চাইতে বেশি কিছু কর না। এখন নিজের চোখে দেখছি আমার অভিযোগ ভুল! তারা অবশ্যই পথে নামতে পারে। শুধু নামতে পারে নাÑ তারা পথে দিনরাত থাকতেও পারে।
গাড়িতে আসতে আসতে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা হলো, কয়েকজন ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন। কিভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়, বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সেটাকে তুলে নিয়ে যেতে হয় সব তাদের নখদর্পণে। তাঁরা নানা ধরনের দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে লাগলেন। বলতে লাগলেন এ ধরনের বিচিত্র একটা আন্দোলন অনির্দিষ্টকাল চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কাজেই এখন এটাকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এই তরুণ ছেলেমেয়েদের যেটা জাতিকে দেখানোর প্রয়োজন ছিল সেটা তারা দেখিয়ে দিয়েছে। তারা প্রমাণ করে দিয়েছে এই দেশের তরুণ প্রজন্ম দেশকে তীব্রভাবে ভালবাসে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের শেষ তারা দেখতে চায়। আমার রাজনীতিতে অভিজ্ঞ বন্ধুরা বললেন, এই তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বোঝাতে হবে সব খুব চমৎকার একটা জায়গায় পৌঁছেছে, এখন তাদের ঘরে ফিরে যেতে হবে-যেন তাদের ভেতরে একটা বিজয়ের অনুভূতি থাকে। এসব ব্যাপারে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই, তাই যে যেটাই বলে আমি শুনি এবং মাথা নেড়ে যাই।
আট তারিখ ইমরান নামে একজন আমাকে ফোন করল, সে শাহবাগের তরুণদের একজন, আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি বললাম-বিকেলে যে মহাসমাবেশ হবে আমি সেটা দেখতে যাব। তখন দেখা হতে পারে। ইমরান নামটি একটু পরিচিত মনে হলো, শাহবাগের তরুণদের মাঝে যে কয়জনের নাম শোনা গেছে তার মাঝে ইমরান একজন। পেশায় ডাক্তার।
যাই হোক বিকেলে আমি আর আমার স্ত্রী ইয়াসমিন শাহবাগে গিয়ে হাজির হলাম। যেদিকে তাকাই সেদিকেই মানুষ। আমি চোখের কোণা দিয়ে খুঁজতে লাগলাম আমার মতো বয়সী এক সাদা চুলের এক দুইজন দেখা যায় কি না! কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম তখন একটু স্বস্তি বোধ করলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কয়েকজন শিক্ষকও শাহবাগে এসেছে, তাদের নিয়ে আমরা পথে বসে পড়েছি। আমার ভাই বোন ঢাকা থাকে, তারা এর মাঝে শাহবাগ ঘুরে গেছে। তাদের কাছে শুনেছি শাহবাগের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে সেখানকার স্লোগান। এ রকম স্লোগান নাকি পৃথিবীর কোথাও নেই!
আমরা পথে বসে বসে সেই স্লোগান শুনছি। মাঝে মাঝে বক্তৃতা হচ্ছে, সেই বক্তৃতাও শুনছি। চারপাশে যেদিকে তাকাই সেদিকেই মানুষ শেষবার এক সঙ্গে এত মানুষ কখন দেখেছি আমি মনে করতে পারি না। হঠাৎ করে শুনলাম মাইকে আমার নাম ঘোষণা করে আমাকে মঞ্চে ডাকছে। আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম, মাথার মাঝে একটু দুশ্চিন্তা খেলা করে গেল, যদি আমাকে বক্তৃতা দিতে বলে তখন কি করব?
যাই হোক আমি আর ইয়াসমীন মানুষের ভিড়ের মাঝে দিয়ে হেঁটে হেঁটে মঞ্চের দিকে যেতে থাকি। মঞ্চটি খুবই সহজ সরল, একটা খোলা ট্রাক। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে যে গণজমায়েত করেছিলেন সেই মঞ্চও ছিল খোলা ট্রাক। আমার মায়ের কাছে তার গল্প শুনেছি, আমার মা সেখানে ছিলেন।
দর্শক-শ্রোতা আমাদের পথ করে দিল, আমি আর ইয়াসমীন ভিড়ের মাঝে হেঁটে হেঁটে ট্রাকের কাছে হাজির হলাম, দুজনকে মোটামুটি টেনে হিঁচড়ে ট্রাকে তুলে দেয়া হলো। ট্রাকের ওপর উঠে একটু স্বস্তি পেলাম সেখানে আমার পরিচিত অনেকেই আছে। যারা ব্লগার তাদের মাথায় হলুদ ফিতা বাঁধা। ইমরান নামের ডাক্তার ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় হলো। হেঁটে হেঁটে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি, যতদূর তাকাই শুধু মানুষ আর মানুষ। এরা সবাই যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে এখানে এসেছে, দেখেও আমার আশা মিটে না, যত দেখি ততই অবিশ্বাস্য মনে হয়।
সামনে একজন একজন করে বক্তৃতা দিচ্ছে। মাঝে মাঝেই বক্তৃতা থামিয়ে স্লোগান। মানুষ যেভাবে কনসার্টে গিয়ে গান শুনতে চায়, অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি এই বিশাল জনসমাবেশ দেখে মনে হলো এখানেও সবাই বুঝি সেভাবে স্লোগান শুনতে এসেছে। গান শুনে মানুষ যেরকম আনন্দ পায় মনে হচ্ছে স্লোগান শুনে সবাই বুঝি সেই একই আনন্দ পাচ্ছে। আমি হেঁটে হেঁটে ট্রাকের পেছনে গিয়েছি তখন লম্বা একটা ছেলের সঙ্গে কথা হলো। মাথায় হলুদ ফিতা তাই সেও নিশ্চয়ই একজন ব্লগার। আমাকে বলল, “স্যার একটা বিষয় জানেন?” আমি বললাম, ‘কী?’ সে বলল ‘এই পুরো ব্যাপারটি শুরু করেছি আমরা ব্লগাররা! কিন্তু এখন কেউ আর আমাদের কথা বলে না!’ কথা শেষ করে ছেলেটি হেসে ফেলল।
আমি তখনও জানতাম না যে এই ছেলেটি রাজীব, কয়েকদিন পরেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একত্র হওয়া এই তরুণদের নাস্তিক অপবাদ দিয়ে বিশাল একটা প্রচারণা শুরু হবে আর সেই ষড়যন্ত্রের প্রথম বলি হবে এই তরুণটি।
হঠাৎ করে আমার ডাক পড়ল, এখন আমাকে বক্তৃতা দিতে হবে। আমি শিক্ষক মানুষ, দিনে কয়েকবার ক্লাসে গিয়ে টানা পঞ্চাশ মিনিট কথা বলি। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের নানা ধরনের আয়োজনে কথা বলতে হয়। সেখানে মাঝে মাঝে দুই চার হাজার উপস্থিতি থাকে সেখানেও কথা বলেছি। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। আমার সামনে পেছনে ডানে বামে নিশ্চিতভাবেই কয়েক লাখ মানুষ! আমি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কি বলব? কিভাবে বলব?
আমি তখন আমার মতো করেই বললাম, কী বলেছিলাম এখন আর মনে নেই, শুধু দুটো বিষয় মনে আছে।
এক. তরুণ প্রজন্মের ক্ষমতাকে অবিশ্বাস করেছিলাম তারা শুধু ফেসবুকে ‘লাইক’ দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলে বলে যে অভিযোগ করেছিলাম সে জন্য তাদের কাছে ক্ষমা চাইলাম।
দুই. রাজীবের মনের দুঃখটা দূর করার জন্য আলাদাভাবে তরুণ প্রজন্মের ব্লগারদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম! রাজীব সেটা শুনেছিল কী না আমি জানি না।
শাহবাগের তরুণদের এই বিশাল সমাবেশ শাহবাগ থেকে ধীরে ধীরে সারাদেশে তারপর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। যখন একটা আন্দোলন এ রকম তীব্রভাবে মানুষের আবেগকে স্পষ্ট করতে পারে তখন তাকে ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই।
তারপর বহুদিন পার হয়ে গেছে। শাহবাগের এই বিশাল সমাবেশকে এখন সবাই গণজাগরণ মঞ্চ বলে জানে। সুদীর্ঘ এক বছর এটি অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মাঝে দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। অপ্রতিরোধ্য এই গণবিস্ফোরণকে ঠেকানোর জন্য যুদ্ধাপরাধীর দল এমন কোন কাজ নেই যেটি করেনি। তাদের শেষ অস্ত্র হচ্ছে ধর্ম, সেই ধর্মকে তারা হিংস্রভাবে ব্যবহার করেছে। হেফাজতে ইসলাম নামে অত্যন্ত বিচিত্র একটা সংগঠন হঠাৎ করে গজিয়ে উঠল। তাদের তা-বের কথা এই দেশের মানুষ কখনো ভুলবে না।
গণজাগরণ মঞ্চ সেই ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে। এক বছরে তাদের অর্জন কেউ খাটো করে দেখবে না। যে কাদের মোল্লার শাস্তি দিয়ে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই কাদের মোল্লার শাস্তি কার্যকর করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আজ থেকে শতবর্ষ পরে যখন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হবে সেখানে একটি কথা খুব স্পষ্ট করে লেখা হবে। এই দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য একটা সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্বটা পালন করেছিল গণজাগরণ মঞ্চ।
বাংলাদেশকে গ্লানিমুক্ত করার প্রক্রিয়ায় তাদের অবদানের কথা কেউ ভুলবে না। ভবিষ্যতে আমরা তাদের কাছে আর কী প্রত্যাশা করতে পারি?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
সাহস২৪ ডটকম-এর প্রকাশিত প্রচারিত কোনো সংবাদ তথ্য, ছবি, রেখাচিত্র, ভিডিও, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪ ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এসব মন্তব্যের কোনো মিল নাও থাকতে পারে। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে সাহস২৪ ডটকম-এর কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো দায় নেবে না।